[প্রথমপাতা]

 

 

১৯৪৮ থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনাঃ

বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক রওশন আলম
 

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বোনা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। মুখের ভাষার অপমান সেদিন মেনে নেয়নি বাঙালি। আসলে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগে থেকেই। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাল্টা বাংলা ভাষার প্রস্তাব দেন।

কমিউনিটির কথা হচ্ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের মহান সৈনিক জনাব রওশন আলমের সাথে। তিনি আমাদেরকে ভাষা আন্দোলনের সময়কার কিছু ঘটনাপঞ্জি বর্ণনা করেন। টেলিফোনে ধারনকৃত তার এই সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলোঃ

প্রশ্নঃ ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঠিক কি কি ঘটেছিল একটু বলবেন?

উত্তরঃ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং এর উল্টা দিকে আমি, ডঃ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ আরো অনেক ছাত্র শিক্ষক জড়ো হয়েছিলেন। সে সময় আমরা একটি সভা করি যে সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি-না। প্রয়াত ভাষা সৈনিক গাজিউল হক এ সভার সভাপতিত্ব করেন। সভায় বিপুল ভোটে সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবো।

গাজিউল হককে আমি আগেই চিনতাম। তিনি প্রায়ই আমার রুমে আসতেন আড্ডা দিতে। পাকিস্তানীদেরকে ঠাট্টা করে বলতেন "সাহেব জব যাওগে সাথ সাথ কুত্তাকো ভি লে যাও।" অর্থাৎ ইংরেজ সাহেবরা চলে যাবার সময় তোমাদের পাকিস্তানী কুকুরদেরকেও নিয়ে যাও। তিনি এ ধরনের আরো বিভিন্ন বামপন্থী গান গাইতে বেশ পছন্দ করতেন।

যাইহোক ঐদিন মিছিলের উপর প্রথমদিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। সে সময় বাতাস বইছিল পুলিশের অবস্থানের অভিমুখে তাই দেখে কেউ কেউ নিক্ষিপ্ত টিয়ার শেল কুড়িয়ে আবার পুলিশের দিকেও ছুঁড়ে দিচ্ছিল। এ সময় আমি রুমাল ভেজানোর জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ঢুকে পড়ি। সে সময় হোষ্টেলে দেয়াল ছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। প্রায় তখনই শুনতে পাই হালকা কট কট আওয়াজ। প্রাথমিক ভাবে বুঝতে পারিনি কিন্তু একটু পরেই জানতে পারলাম পুলিশ মিছিলে গুলি ছুঁড়েছে। একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকেই ছুঁড়েছে বলে শুনলাম। প্রায় সাথে সাথেই নিহত হন বরকত ও রফিক। তারাই ছিলেন প্রথম ভাষা শহীদ। সবাই ধরাধরি করে গুলিতে আহতদেরকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসল।

প্রশ্নঃ সেদিন ক'টার দিকে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল?

উত্তরঃ যদ্দুর মনে পড়ছে বিকেল ৩ টার দিকে।

প্রশ্নঃ গুলিচালানোর এই ঘটনার পর আপনারা কি করলেন?

উত্তরঃ গুলি চালানোর প্রতিবাদে ঐ দিন সন্ধ্যায় আমরা একটি প্রতিবাদ সভা করি। সেখানে আমি সহ আরো কয়েকজন বক্তৃতা রাখেন।

প্রশ্নঃ সে সময় ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য সে সময় আপনাকে পাকিস্তান সরকারের কি ধরনের রোষানলে পড়তে হয়েছিল?

উত্তরঃ সে সময় আমি দু'বার গ্রেপ্তার হই। একবার ৪৮ এ ও পরে ৪৯এ। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারনে আমাকে পরবর্তীকালে বিমান বাহিনী ছাড়তে হয়।

প্রশ্নঃ প্রথমবার আপনি কি ভাবে গ্রেপ্তার হন?

উত্তরঃ আসলে ৫২র ভাষা আন্দোলনের আগে সর্বপ্রথম ভাষার যে দাবি ওঠে তা হচ্ছে এর চার বছর আগে ১৯৪৮ সালে। সেটিই ছিল আসলে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ এর ১১ই মার্চ প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরা বিক্ষোভ করি। সেদিনই আমি প্রথমবারের মত গ্রেপ্তার হই। আমি ছাড়াও গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, রফিকুল আলম, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ।

প্রশ্নঃ ৪৮ এ যে আন্দোলন হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট কি ছিল?

উত্তরঃ ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গন-পরিষদে তার বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ লোকের ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি করেন। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গনপরিষদের মুসলিম লীগের সদস্যরা এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বক্তৃতা দেন। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা বলে উল্লেখ করেন।

গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের এক সমাবেশ হতে ছাত্ররা ১১ই মার্চ ধর্মঘট আহবান করে। ১১ই মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে।

প্রশ্নঃ পরেরবার কিভাবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন?

উত্তরঃ ১৯৪৯ সালে আমি আবার গ্রেপ্তার হই। সে সময় শিবেন মিত্র তার কিছু দাবিতে অনশন করেন। সরকার তার অনশন ভাঙতে গিয়ে ফোর্স ফিডিং করানোর চেষ্টা করলে খাবার খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে সে নিউমনিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরে সে মারা যায়। তখন আমরা এর প্রতিবাদে একটি সভা করি। আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। সেদিন রফিকুল আলমও আমার সাথে ছিলেন। আমরা কেন্দ্রীয় কারাগার অভিমুখে মিছিল করে গেলে পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে। জেলে আমি অনশন করি। তারা আমাকেও ফোর্স ফিডিং করানোর চেষ্টা হয়। ফলে আমিও ডবল নিউমনিয়ায় আক্রান্ত হই। সে সময় সরকার কিছুটা ভড়কে যায়। যদি আমারও একইরকম মৃত্যু হয় তবে সরকার বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে। তারা আমার পিতার কর্মস্থাল টাংগাইলে চিঠি পাঠালো। বাবা এসে আমাকে নিয়ে যান।

প্রশ্নঃ এরপর কি ঘটে?

উত্তরঃ জেল থেকে মুক্ত হয়ে আমি বেশ কিছুদিন গুরুতর অসুস্থ্য থাকি। পরবর্তীতে আর সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানো হয়নি।

প্রশ্নঃ সে সময়ের ছাত্র রাজনীতির আলোকে এ সময়ের ছাত্র রাজনীতির কি মূল্যায়ন করবেন?

উত্তরঃ সে সময়ের সাথে এখনকার ছাত্র রাজনীতির তুলনা করাটা সমীচীন নয়। সে সময়ের ছাত্র রাজনীতি ছিল কোন আদর্শকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। এ সময়ে আদর্শের অস্তিত্ব কি আসলেই আছে? এখনকার ছাত্ররা রাজনীতিতে আসে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসেব কষে। আবার অনেকে ছাত্র না হয়েও ছাত্ররাজনীতিতে নাম লেখায়।

প্রশ্নঃ ভাষা সৈনিকদের কি যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে করেন?

উত্তরঃ আমার কাছে মনে হয় যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। ফেব্রুয়ারী মাস এলেই খুব লেখালেখি চলে। কিন্তু তারপর সবাই সব কিছু ভুলে যায়। ভাষার জন্য রক্তদেবার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দিনটিকে এখন সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে। ভাষা আন্দোলন থেকেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের গোড়াপত্তন বলা যেতে পারে সে তুলনায় আমার মনে হয় ভাষা সৈনিকদের আরো মূল্যায়ন করার প্রয়োজন ছিল।

প্রশ্নঃ ইদানিং বাংলা ভাষায় মিডিয়ার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাভাষার প্রসারে তারা কি রকম ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তরঃ বাংলা ভাষার প্রসারে মিডিয়া গুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে একথা সত্যি। কিন্তু কোন কোন টিভি চ্যানেল খুললে মনে হয় সেখানে তারা বাংলাভাষাতে ঠিক উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছেনা কিম্বা ভুলে গেছে। বাংলাদেশে থেকে বাংলা ভুলে যাওয়াটা খুব সম্মানের নয় -কিন্তু এটাও বোঝার ক্ষমতা অনেকের নেই।

প্রশ্নঃ কমিউনিটির পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি?

উত্তরঃ এটা খুবই প্রশংসনীয় যে জাপান থেকে অনলাইনে একটি বাংলা দৈনিক আপনারা বের করছেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই বাঙালীরা আজকে বাংলা ভাষায় পত্রিকা বের করছেন। এ সবই বাংলাভাষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

কমিউনিটিঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

উত্তরঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।

এরই সাথে শেষ হয় মহান ভাষা সৈনিকের সাথে আমাদের সাক্ষাতকার পর্বটি। জনাব আলম ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন এই প্রত্যাশাই রইল।

 

[প্রথমপাতা]