[প্রথমপাতা]

 

 

 

 বি ব র

 

অংশু মোস্তাফিজ

কালো এক ছায়া দেখে চমকে উঠলো রমেন। আশে পাশে কেউ নেই। ছায়া এলো কেত্থেকে? মাথাটা ঘুরে উঠলো, দৃষ্টি ঝাপসা। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। বুঝতে বাকি থাকলো না। শক্ত হবার চেষ্টা করলো সে। এর আগেও কয়েকবার রাস্তায় মাথা ঘুরে পরে ছিল সে। আবারো চমকে উঠলো রমেন। ছায়াটা আবার দেখলো। ঝাপসা বালিকামুর্তি। আবারো চারদিকে তাকিয়ে দেখলো, আশে পাশে কেউ নেই। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো রমেন, সব ঠিকঠাক। ছায়া এলো কেত্থেকে? সাতাশ জ্যৈষ্ঠ্য, গড়িয়ে আসা বেলা, পাটগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে। পাটগ্রাম প্রেসক্লাব, পাটগ্রাম, লালমনিরহাট লেখা পড়ে দেখলো। আবারো হাটতে শুরু করলো রমেন। আশেপাশে লোক নেই। একটু জোরে হাটতে শুরু করলো রমেন। ক্লান্তি শরীরময়। আজ সকালে রমেন এক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। সকালে, যখন অফিসের দিকে যাচ্ছিলো রমেন, নির্মাণাধীন একটা বাড়ির ছাদ থেকে কিছু ভারী কাঠ পরেছিল কাঁধে। তার একটা মাথাতে আঘাত করেছে। সে যখন বিষয়টা সম্পর্কে পুরোপুরি জানলো তখন সে ক্লিনিকে। একজন মহিলা তার তত্ত্বাবধায়নে ওকে সড়ক থেকে ক্লিনিকে এনেছে বলে জানানো হয়েছে। একজন নার্স কিছু একটা ওয়ার্ডবুকে লিখে ক্লান্তিঝেড়ে চলে গেল। এবং যাবার আগে আগে বলে গেল, আপনি সেড়ে ওঠায় আমরা খুশি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে যেতে পারবেন। যাবার আগে ফোন নাম্বার রেখে যাবেন, উনি চেয়েছেন, যিনি আপনাকে এখানে এনেছিলেন। উনি আবার আসবেন বলেছেন, ইচ্ছে করলে দেখা করে যেতে পারেন। রমেন অনেকটা পথ হেটে এসে মনে করলো, দেখা করে আসা উচিত ছিল। কিন্তু ফিরে যাবার মত ইচ্ছে হলো না আর। ক্লান্তি শরীরময়।
অফিসে না যাবার কারন উর্দ্ধোতনকে জানানো প্রয়োজন। ফোনে পয়সা নেই। রুমের বাইরে যেতে ইচ্ছে করলো না। কারো কারো ইচ্ছের চেয়ে অনিচ্ছাই বেশি, রমেন তাদের দলে, বলেছিল হাইস্কুলের প্রেমিকা। রমেনের ধারণাও একই রকম। ট্রাঙ্ক খুলে ভদকার বোতল বের করলো সে। শেষের দিকে। অপরিচিত এলাকা। কোথায় কি পাওয়া যায় জানতে কিছুটা সময় লাগবে। দ্রুত খোঁজ নিতে হবে। মশাড়িটা টানিয়ে শুয়ে পড়লো রমেন। মশার প্রকোপ। আজ এ রুমে দ্বিতীয় দিন। আজ এ মফস্বলে দ্বিতীয় দিন রমেনের। ঘুম থেকে জেগেই পাওয়া একটা ফোনে রমেন ঐ মহিলার অভিনন্দন পায়। জানায় গতকাল তাকে তিনি ভর্তি করিয়েছিলেন ক্লিনিকে। বেশ কথা বলতে হলো মহিলার সঙ্গে। ভদ্রতা বজায় রাখা উচিত হবে। উনি সড়ক থেকে কাল অজ্ঞাত এক অজ্ঞানকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছিলেন। সবশেষে সম্ভব হলে আজকেই রমেনকে বাসায় যেতে বলেছেন মহিলা। ভদ্রতা করে তাতেও রাজি হয়েছে রমেন। তিনদিন পর বিপত্তিটা ঘটলো। তার বাড়িতে গিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো রমেন। প্রকান্ড বাড়ি। মহিলার নাম মনে করতে গিয়ে মনে হলো, তার নাম শোনা হয়নি। না, সমস্যায় পড়তে হলো না। অন্দরমহলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতেই কেউ একজনকে দেখা গেল আবছা অন্ধকারে। বেশকিছু সময় রোদে হেঁটে আসার পর অন্দরমহলের কাছে এসে চোখে আবছা দেখছে রমেন। কিছু বলার আগে পঞ্চাশোর্ধ মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, রমেন তো, এসো ভেতরে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ছিমছাম দ্বিতলা শাদা রঙের বাড়ি। বিশাল এড়িয়া। গাছ, পুকুর সব আছে। অন্দরমহলের ভেতরেও গাছ আছে। বনসাই আছে। দু’একজন কাজের লোক ছাড়া আর কাউকে দেখা গেলো না এদিকে। মহিলা চা পান করছেন। রমেনের চা’তে অভ্যেস নেই। কি নাম আপনার জিজ্ঞেস করলো রমেন। ভদ্রমহিলা বললেন, অন্নপর্না দেবী। এ মহিলাকে মন্দ লোক বলে মনে হয়নি। ছোটসময়ের কথা মনে পড়লো, আশ্রমের হুজুর বলেছিল, হিন্দুরা অত ভাল মানুষ হয় না। মিথ্যে মনে হলো রমেনের। অন্নপর্না দেবী ভাল মানুষ। এতো বড় একটা বাড়িতে থাকলে মানুষ এমনিতেই বড় হয়ে যায়। সমুদ্রে দাঁড়ালে মন পবিত্র হয়। ভালকথা, এবার বদলি হলে সমুদ্রের দিকে যাবার ইচ্ছে জানাতে হবে, সে মনেমনে ভাবলো।
বাস্তবে ভদ্রমহিলা কম কথা বলেন। বললেন, ভালবোধ করছো তো রমেন? খাবে কিছু? এখন না খেলেও রাতে খেয়ে যাবে। চা শেষ করে আমরা ছাদে বসবো। গল্পগুজব করবো। আশেপাশে লোক পাইনা বুঝলে। একা মানুষ। তুমি মাঝেমাঝে আসবে। ভাল লাগবে আমার। রমেন, আসবো বলে আর কিছু বললো না।
ছাদের উপরে কতক ধরণের গাছ। খরগোশ। গাছের চেয়ারে বসে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িটা পছন্দ হয়েছে তোমার? দারুন, রমেনের উত্তর। অন্নপর্না দেবী বললেন, দীপাবলীর গল্প জানো? দীপাবলীর কিছু ছাপ আমার কপাল থেকে নেয়া বুঝলে। অদ্ভুতভাবে একটা জীবন কাটিয়ে এলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তোমার খবর কি, বাড়িতে কে কে আছেন? বাড়িতে’ শব্দ রমেনের কাছে বেখাপ্পা লাগলো। বললো বাড়ি নেই আমার। কখনোই ছিল না। প্রশ্নবোধক চোখে একটু মুখ বেঁকালেন অন্নপর্না। রমেন তার দিকে একটু ঝুকে বললো, সুন্দর একটা প্রোফাইল জানাবো আপনাকে, দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করবেন না কিছু। ভদ্রমহিলা ঠিকআছে বললেন। রমেন বললো, এগার বছর বয়সে এতিমখানা থেকে পালিয়ে আসা ছেলে আমি। পরবর্তীতে টোকাইগিরি করে চলেছি অনেকদিন। পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া ছিল আমার সেরা সিদ্ধান্ত। পরবর্তীতে ভদকা খাওয়া শিখে রমেন হয়েছি। এরপর বাউল হবো। অন্নপর্না দেবী বেশকিছু সময় পরে বললেন, অদ্ভুত ছেলে তুমি, বেঁচে থাকো।
ঘুমের মধ্যে ছায়াস্বপ্নটা দেখছিল রমেন। বালিকামূর্তির সেই ছাঁয়াটা, যেখানে কোন বালিকা ছিল না। রোদ, ভরদুপুর, চারদিক আশ্চর্য নিরবতা ছিল, প্রেসক্লাব, প্রেস.., ..., ... লেখা ছিল। যখন ঘুম ভাংলো, বেলা তিনটে। অফিস যাওয়া হলো না। গতকাল নতুন অফিসে জয়েন করার কথা ছিল। আজও হলো না। উর্দ্ধোতনকে কি জানানো যায়, সুবিধাজনক কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো রমেন। ইতোমধ্যে একটা ফোন রমেনকে জানায়, সুমু বলছে। বললো, তোমার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, আর কখনো মুখ দেখবো না আমরা। কাল বিকেলে আমার শ্বাশুড়ীর সঙ্গে ছাদে গল্প করতে দেখেছি তোমাকে। প্রতিদিন শ্বাশুড়ীর বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় আমাকে। এ বাড়িতে আর এসো না। আমি বিব্রত হবো। ভালথেকো বললো সুমু। অনেকগুলো প্রেমিকার মুখ মনে পড়লো। হাইস্কুলের প্রেমিকারও। শেষের দিকে যে বলেছিল, নষ্ট মানুষ তুমি। তার আগে তার গর্ভে একটা ছেলে কি মেয়ে এসেছিল। একটু পরে অন্নপর্না দেবীর ফোন, কাজ না থাকলে বিকেলে যেতে বললেন। রমেন ঠিকআছে বললো। ভদকা শেষ। গোটা মফস্বল ঘুরে মাত্র কিছু বাংলামদ পেল রমেন। পরদিন সকালে অফিসে গেল বদলীর আবেদন লিখে নিয়ে। অফিস রাজি হলো না। ভরদুপুরে ট্রাঙ্ক গুছিয়ে রাস্তায় নামলো রমেন। পাটগ্রাম প্রেসক্লাব, পাটগ্রাম, লালমনিরহাট লেখা সাইনবোর্ড দেখে রমেন থকমে গেল। বোঝার চেষ্টা করলো কি পড়লো সে, পাটগ্রাম প্রেসক্লাব, পাটগ্রাম, লালমনিরহাট নাকি দৌলদিয়া প্রেসক্লাব, দৌলদিয়া, রাজবাড়ি? অন্নপর্না দেবী রমেনের এনজিওতে গিয়ে জানতে চাইলো রমেনের চাকরি ছাড়ার কারন কি। একজন জানালেন কাহিনী অদ্ভুত। দৌলদিয়া থাকার সময় একটা কিশোরী ওর জন্য আত্মহুতি দিয়েছে। রমেন ওতে রাজি ছিল না। মেয়েটি শরীর বিক্রি করতো। বদলি নিয়ে এখানে জয়েন করতে এসেছিল। তিনদিন পর এসে জানালো, এখানে থাকলে আরো একজন আত্মহুতি দিতে পারে। বদলি চাইলো কুয়াকাটায়। অফিস রাজি হয়নি। অন্নপর্না দেবী ফিরে গেলেন। যাবার সময় বললেন, অদ্ভুত ছেলে। পরবর্তীতে তার ছেলেবউয়ের ফোনে রমেনের নাম দেখলেন অন্নপর্না দেবী। রকমারী গাছ আর খরগোশ থাকা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। দাঁড়িয়ে থাকলেন। ফিরে এসে এই গল্পের আরো কিছু ছেড়া পাতা খুঁজলেন অন্নপর্না দেবী। ছেড়া হলেও পাঠযোগ্য পাতাগুলোয় কিছু পড়তে পারলেন না তিনি। কারন লেখাগুলো এতো ছোট ছোট আর এতো তীক্ষè তাকে চোখে ধরে না। তিনি আরো কিছুদিন অদ্ভুত ভেবে পৃষ্ঠা উল্টালেন আর দেখলেন, বেঁচে থাকার অনুভূতিগুলো কেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর কত মারাত্মক।

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
 

[প্রথমপাতা]