[প্রথমপাতা]
|
পূর্নিমার সোনারং শরীরে কেউটের ছোবল
শরীফা বুলবুল
বড়ো হওয়ার পর থেকে বাবা আমাদেরকে একটি কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন, তা হচ্ছে
যে মাটির উপর বসে আছি সে মাটিটা আমাদের নিজেদের নয়। জš§ থেকে ওই কথাটাই শুনে
আসছি। এই আদিগন্ত বি¯তৃত সবুজের সমারোহ, এর আনন্দ, এর সুখ অথবা সাগরের নোনা
ঢেউ, এর বুক চিতানো ওঠা-পড়া, এসবের কোনো কিছুই আমাদের নয়! কোন কিছুতেই নেই
আমাদের কোনো অধিকার! এ রকম কথা শুনতে শুনতেই শৈশব যৌবন কৈশোরের দিনগুলো কেটে
গেছে এক অবর্ননীয় ব্যথায়। বলা যায় সৌন্দর্যকে ধরতে না পারার বেদনায় কেটে গেছে
আমাদের সোনাঝরা দিনগুলো। কেন যেন স্বপ্নের বাগানটি কিছুতেই গোছাতে পারি না।
স্বপ্নগুলো এলোমেলো এবং তছনছ হয়ে পড়ে থাকে বুকের বারান্দাজুড়ে। কিন্তু কেন আমার
কোনো অধিকার নেই! এই প্রশ্নটা মগজের কোষে কোষে কেবল ঘুরপাক খেয়েছে শুধু। কোনো
উত্তর খুঁজে পাইনি। একধরনের গরীব প্রজার মতো করে মাথা নূয়ে থাকার প্রবনতা হয়ে
উঠেছে যেন আমাদের নিয়তি। কোনো দিন উচ্চ স্বরে কথা বলতে গেলে আবার সংকুচিত হয়ে
পড়তাম তারও বেশী। এটা তো আমাদের দেশ নয়।
আমাদের আনোয়ারা গ্রামের অনতিদূরে সমুদ্রের পাশাপাশি বাস করি আমরা প্রায়
চল্লিশটির মতো জেলে পরিবার। তাই এটা জেলেপাড়া হিসাবেই পরিচিত। জল, জাল নৌকা
আমাদের জীবন যাপন প্রণালীর সঙ্গে এক সূতোয় গাঁথা যেন। জেলে পাড়ার আঁশটে গন্ধভরা
বাতাসে ছেঁড়াফাটা দিনরাতকে নাছোড় জীবনের সাথে গেঁথে দুঃখকে সুখ ভেবে আমরা
স্বপ্ন সাজাই বার বার। তুচ্ছ খড়কুটোর মত কিছু আনা সঞ্চয় করে রাখি বুকের
প্রান্তরে। কিন্তু বার বার তুখোড় ঝড় তছনছ করে দেয় সব সঞ্চয়। স্বপ্নের হাটে হানা
দেয় হায়নার দল। লণ্ড ভণ্ড করে মুছে ফেলতে চায় জীবন জীবিকার চিহ্ন। তবুও জীবনের
তাগিদ, Ñ পোড়া দগ্ধ ভিটায় আবারও ঘরবাধা, বিশ্বাস অবিশ্বাসের বিমর্ষতায় আবারও
দিনযাপন।
দেশের কোন রাজনৈতিক উত্থানপতনে, ধর্মীয় উš§াদনায় ভয়ের খড়গ ঝুলে পড়ে আমাদের
ঘাড়ের উপর অকারণে। একাত্তরে, নব্বই-এ আমাদের উপর ওইসব নগ্ন কুৎসিত চেহারা দেখে
আঁৎকে উঠেছি। ভয় পিড়ি পেতে থাকে মনের ভেতর। এই বুঝি হামলে পড়বে কেউ। মনের
মলিকিউলে কষ্টের লাল পিঁপড়ে কেবল কামড় দেয়।
আমি সুরবালা জলদাস একাত্তরে আমার জীবনটা ছিল অন্যরকম, আমরা স্বামী স্ত্রী আর
আমাদের সন্তান প্রানেশকে নিয়েই ছিল ছোট্ট পৃথিবী। মনের এক কোণায় খুঁদকুড়োর মত
স্বপ্নের সামান্য সঞ্চয়, রাতের অন্ধকারে সুখেন জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লে প্রানেশকে
বুকে নিয়ে আমার ছিল একাকী রাত্রিবাস, কুকুর শেয়ালের ডাকে আঁৎকে ওঠার অস্বস্তি,
ভোরে সুখেনের ডাকে একঝাঁক রূপালী মাছের দাপট স্বপ্ন থেকে টেনে নিয়ে আসতো আমাকে
চেনা সুখের বন্দরে, সেই স্মৃতির কথা মনে হলে মনেহয় আমার এখনও আমি যুবতী, এখনও
টগবগে তেজ।
যে মানুষটা আমার জীবনে হাজারো দুঃখেও শান্তির ওম ছড়াতো ওরা তাকে নির্বাসিত করলো
মৃত্যুর দণ্ডকারণ্যে, তার অপরাধ একটাই একাত্তরের অন্ধকার রাতে মাঝে মাঝে তার
নৌকাতে উঠে আসতো দেবদূত। খুব সাবধানে বিশ্বস্ততার সাথে আমার স্বামী সুখেন এদের
পারাপার করতো। বিদেশী হায়নার দেশী চর নিজ হাতে দণ্ড দিল সুখেনকে। তার নৌকাতেই
গুলি করে লাশটা ফেলে দিল পানির ভেতর। আমার ছেঁড়া বৃক্ষের মত উপড়ে পড়ার দশা তখন,
খেয়ে না খেয়ে ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে প্রানেশকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম কোন মতে, যুদ্ধ
শেষের অনিবার্য পরিণতির টানে আবার ফিরে আসি দগ্ধ, পোড়া ভিটেয়। কিন্তু পোড়াঘরের
দাহ ক্ষুধা হয়ে, দারিদ্র্য হয়ে ভয়ঙ্কর দৈত্যের মত প্রহার করতে লাগলো আমাকে,
দিশেহারা আমি একমাত্র সঞ্চয় জাল, নৌকো বিক্রি করে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ফিরে
পেলাম আবার।
সেদিনগুলো ছিল প্রচণ্ড খরার, মাটিতে বুক লেগে যাওয়ার কষ্টে দিশেহারা আমি অসহায়
চোখে দেখলাম শুধু সদ্য স্বাধীন দেশে সুযোগ সন্ধানীর দল এর সুখ সম্পদের শাখা
প্রশাখার বি¯তৃতি। সবার মনের পর্দা থেকে মুছে গেলো সুখেনের মুখ। মুক্তিযুদ্ধে
সুখেনের এত বড় ত্যাগের সামান্যতম স্বীকৃতিও মিললো না জাতির কাছ থেকে। শুধুমাত্র
আমারই বুকের ভেতর ঠাঁই করে নিলো সুখেন। স্মৃতির ঘোলাজলে নৌকার বৈঠায় ছলাৎ শব্দ
তুলে ঢেউ এর আগায় নেচে বেড়ায় সুখেন। তখন উথলে ওঠা একটা কষ্ট বুকের ভেতরটায়
শ্বাসরোধ করতে প্রবল হয়ে ওঠে। চারপাশের শূন্যতা অপ্রতিরোধ্য ঘূর্ণি হয়ে আঘাত
করে আমাকে।
আমাদের তবুও বেঁচে থাকা। ধ্বংস¯তূপের আড়ালে ভাঙা ইটের পাঁজার ভেতর চারাগাছটিকে
লুকিয়ে বড় করা, একদিন তার ছায়াবৃক্ষ হবে প্রানেশ।
নিজের সমস্ত পরিশ্রমের ক্লান্তি, অবসাদকে নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখে বুকে বুকেই বড়
করছি প্রানেশকে। লেখাপড়ার ঝামেলা মুক্ত পরিবেশে তাড়াতাড়ি সংসারের হাল ধরেছে
আমার প্রানেশ। প্রথম প্রথম পরের নৌকায় কামলা খাটা শেষে সব কিছু নিজের আয়ত্বে
আনে করিৎকর্মা ছেলেটি। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচি।
বিয়ের পর জেলেপাড়ার সবাইকে সচকিত করে দিয়ে প্রানেশের সংসারে আসে পূর্নিমা। আমি
তো অবাক। জেলেপাড়ায় যে এরূপ পূর্নিমার আলো বেমানান। বুকের তলানিতে এসে ঠেকে
যাওয়া সামান্য সুখ আবার চেটেপুটে নিই আমি, পূর্নিমা এখন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী,
সারাদিন তাকে আগলে রাখাই আমার কাজ।
মাঝে মাঝে অবশ্য দুশ্চিন্তার মেঘ উঁকি মারে মনের কোনটুকুতে, আমার সুখের ভরা
সংসারে আবার যদি মত্ত হাতির পাড়া পড়ে,-কারণ দেশের কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতির
সাথে জেলেপাড়ার কেউ সম্পৃক্ত না হলেও এর দায়ভার কিন্তু বহন করতে হয় আমাদের,
আমার আশঙ্কাই সত্যি হোল নব্বই এর এক রাতে নিরাপদ, নিশ্চিন্ত ঘুমের ভেতর টুঁটি
চেপে ধরলো হায়নার দল। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে প্রানেশ আর তার বউ খুন হোল
ওদের হাতে। অন্য ঘর থেকে পূর্নিমাকে কোলে নিয়ে পালিয়ে প্রানে বাঁচি।
তারপর থেকে মাঝে মাঝে নিজেকে পাগল পাগল ঠেকে। জীবনের বাঁকে বাঁকে আর কত দুঃখ,
কটু স্বাদের দিনরাত্রিতে যেন অসহ্য বসবাস, পূর্নিমা বেড়ে উঠছে যেন লাউয়ের ডগার
মতো। ওর রূপ দেখে শিউরে উঠি আমি, আমার প্রানেশের এ আমানত, পরের হাতে তুলে দিতে
পারলেই কেবল আমার শান্তি, স্বস্তি।
দেশে কিছুদিন আগে ভোট হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের আগুনের হলকা এসে লাগতে পারে
এই নীরিহ জেলে পাড়ায়।
এ কথা মনে এলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কারণ আমার ঘরে সোমত্ত নাতনি, পূর্নিমার
আলো। ওর রূপের এ আগুন কোথায় লুকাবো আমি ? চারদিকে গুজ্ গুজ। ফুস্ ফুস। বাতাসে
ভেসে আসে দুঃসংবাদ। নব্বই এর মত আবার হামলা হবে না তো জেলেপাড়ায় ? বুকের ভেতর
আতঙ্ক আর আশঙ্কার যমজ ছায়া। কোথায় যাবো আমি ? পুরুষহীন সংসার কবুতরের বাচ্চার
মত ডানার নিচে রেখে বড় করেছি পূর্নিমাকে।
ঘর পোড়া আমি বিপদের সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাই, আমার ময়না পাখিটিকে কোথায় লুকাবো
আমি ? কালই প্রানেশের বন্ধু পাশের গাঁয়ের সালামের বাড়িতে রেখে আসতে হবে তাকে
কিছুদিনের জন্য, একটু নিশ্চিন্ত ঘুমের আশা তবুও। সামনের ফাল্গুনে পূর্নিমাকে
পাড় করতে পারলেই বেঁচে যাবো। পাড়ারই ছেলে নরেনের সাথে বিয়ের কথা পাকাপাকি, নগদ
দশ হাজার টাকা, এক জোড়া দুল। ধার দেনা করে এসব জোগাড় করে ফেলেছি। বাকি যৌতুক
আমার পূর্নিমার অসহ্যসুন্দর রূপে শোধ হয়ে যাবে। তারপর হবে আমার নিরাপদ,
নিরুপদ্রব রাত্রিবাস।
এসব ভাবনা দিয়ে মগজের খোড়লে বাসা বুনে চলি। রাতটা একেবারে নিরাপদ নয়। অন্ধকার
মানুষকে বড়ো বদলে দেয়। কি দৈত্যের মত ভয় দেখায়, বাতাসে শোঁ শোঁ আওয়াজ
রাক্ষসপুরীর রাক্ষসের দীর্ঘশ্বাস বলে ভ্রম হয় অন্ধকারকে। এসব এলোমেলো ভাবনা
নিয়ে বালিশের নীচে দা’টা রেখে পূর্নিমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ি। অক্টোবর শেষ হয়ে
আসছে। বাইরে একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। ছেঁড়া ফাটা কাঁথাটাকে গলা পর্যন্ত
টেনে দিয়ে একটু ওম নেয়ার চেষ্টা করি। ভয়ের বাধা নিষেধ সত্বেও ভাঙাচোরা শরীরটা
নিয়ে ধীরে ধীরে একসময় ঘুমের ভেতর ডুবে গেলাম। সেই ঘুমটাই পূর্নিমার এক হ্যাঁচকা
টানে ঘুমের বাড়ি থেকে ঘুম উধাও।
ভয়ার্ত স্বরে কাঁপা কাঁপা গলায় আমার ময়না পাখি বলে, ‘দিদি দিদি ওঠ, ঘরে আগুন
দেছে’।
কে আগুন দিল, কেন দিল, কারা দিল, কি তার অপরাধ এসব প্রশ্নকে দূরে ঠেলে দিয়ে
ধরাস্ করে বিছানায় উঠে বসি, বালিশের নিচে থেকে দা’টা হাতিয়ে নিই। এক হাতে দা
অন্য হাতে পূর্নিমাকে ধরে পিছনের বেড়া কেটে বাইরে বেড়িয়ে আসি।
হঠাৎ হ্যাজাকের তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে যায়। বুক ধরফর করে ওঠে। পরানপাখি ছটফট
করছে। সামনে ওরা কারা দাঁড়িয়ে ? নব্বই এর সেই চেনা শকুন যেন। হ্যাজাক জ্বালিয়ে
উৎসব মুখর পরিবেশে ভাগাড়ের খোঁজে নেমেছে। আমার কোঠরাগত চোখদুটো ভয়ে আতঙ্কে
আবার চোখের কোঠরে ঢুকে পড়ে। হƒদপিণ্ডটা যেন পাকা আপেলের মত টুপ্ করে ঝরে পড়ে
মাটিতে। আমি এখন কি করবো ? আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি এ কোন আগুনের সামনে
এসে পড়লাম! ওরা যে জানোয়ারের চেয়ে হিংস্র, আগুনের চেয়েও নির্দয়।
আমার ভেতর তবুও প্রতিরোধের চেষ্টা। পূর্নিমাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে দা’টা বাগিয়ে
ধরে খেকিয়ে উঠি। ‘তোরা এইখানে কি চাস্?’
ওরা দাঁত কেলিয়ে বলে ওঠে, ‘তর নাতনিরে চাই বুড়ি।’
শেয়ালের মত খ্যাক্ খ্যাক হাসে ওরা,
‘খবরদার অর গায়ে হাত দিবি না।’
‘কেন হাত দিলে কি গায়ে ঠোসা পড়বো ?’
ওদের উš§ত্ত হাসিতে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়, ভয়ে পূর্নিমাকে ঝাঁপটে
ধরি আমি।
‘তরা ওর সর্বনাশ করিস না। ফাল্গুনে অর বিয়া। তরা পূর্নিমার সর্বনাশ করলে অর
বিয়া ভাইঙা যাইবো। নরেন আর তারে ঘরে নিব না।’ আমার কথার পিঠে কথা সাজায় ওরা।
‘তোর আর ভাবনা কি বুড়ি ? আমরা সবাই তোর নাত্ জামাই হইতে চাই।’
আমার বুঝতে আর বাকি নেই আমার পূর্নিমা এখন হায়নার হাটে ঢুকে পড়েছে। তার হাড়
মাংস এখন নিলামে উঠবে। আমার ইচ্ছে করে ওদের লুঙ্গি খুলে দেখতে পেছনে কোন লেজ
গজিয়েছে কিনা। প্রেত কায়ারা ভুতুড়ে গলায় শাসায় আমাকে,Ñ
‘বুড়ি তগোরে কইছিলাম হেই পাড়ে চইলা যা। গেলিনা। এই দেশে থাকলে তো টেক্শো দিতে
অইবো।’
‘কিসের টেক্শো?’
ওদের কথা আমি বুঝতে পারি না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি ?
‘এদেশে অবৈধ বসবাসের টেক্শো, - আপাতত তর নাতনিরে দিয়া শোধ কর।’
কথা বলতে বলতে পূর্নিমার উপর হামলে পড়ে নরপিশাচরা।
‘আমার ময়না পাখিরে ছাইড়া দে বাপ।’
আমার শীর্ণ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষণস্থায়ী, উদ্ধত পশুর কয়েকটা লাথি এসে পড়ে বুকের
উপর, লাউ এর শূন্য খোলের মত আমি গড়িয়ে যাই অনেক দূর। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা জড়
মাংসপিণ্ডের মত পূর্নিমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওরা। ওদের অর্থহীন তান্ডবের দানবীয়
উল্লাসের নিচে চাপা পড়ে যায় আমার আর্তনাদ।
ভোরের আলোর স্পর্শে অথবা সালামের উচ্চকণ্ঠ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। চোখ খুলে মাটির
উপর ধড়ফড়িয়ে উঠে বসি, গত রাতের দুর্ঘটনার দৃশ্যপট স্বপ্ন হয়ে মুছে গেছে হয়তো, Ñ
সালাম আমাকে হাত ধরে টেনে তোলে,
‘কাকী চল পূর্নিমারে খুঁইজে আনি তারে পাওয়া যাচ্ছে না, হুনছি সাগর পাড়ে অনেক
মাইয়ারে ধইরা নিছে, চল হেই দিকে যাই।’
আমি সালামের কাধে ভর করে হাঁটতে থাকি। ক্লান্তিতে উত্তেজনায় ধপাস্ করে বালির
উপর বসে পড়ি।
‘তুমি এইখানে বস, আমি তারে খুইজা দেহি’
সালাম ঝোপঝাড়ের ওদিকে চলে যায়, কেয়ার বনে কয়েকটি নগ্ন, ক্ষত বিক্ষত দেহ। জীবিত,
মৃতের হিসাব মেলাতে পারে না সালাম। একটি মেয়ের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। নগ্ন
শরীরটা উপুড় হয়ে আছে, তাকে ধরে উল্টে দেয় সালাম। হ্যাঁ পূর্নিমাই তো, সদ্য ফোটা
ফুলের মত মুখটা ক্ষত বিক্ষত, চোখ দুটো খোলা উর্ধ্বমুখী কিন্তু পলকহীন, Ñ যেন
আকাশচারী মানবসভ্যতাকে ধিক্কার দিচ্ছে সে।
পূর্নিমার নগ্ন শরীরটা দেখে আমি ছুটে যাই, ‘আমার পূর্নিমা মইরে গেছে নারে সালাম
?’ আমার ময়না পাখি!
সালাম মানুষের এই নৃশংসতা সইতে না পেরে দু’হাতে মুখ ডাকে। পূর্নিমার নগ্ন দেহ
তাকে লজ্জা দিচ্ছে।
আমার কান্না কোথায় উধাও হয়ে গেছে যেন। কান্নার পরিবর্তে হঠাৎ ভেতরে যেন আগুন
জ্বলে ওঠে। সালামের বাধা সত্ত্বেও শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আমি পূর্নিমাকে
টেনে হিঁচড়ে পানিতে নিয়ে যাই।
‘সালাম চেঁচিয়ে ওঠে, কি কর কাকী পূর্নিরে দাহ দেবে না?’
আমি সালামকে বলি, ‘না, ও অনেক আগুনে পুড়ছে তারে একটু শেতল অইতে দে।’
আমার পূর্নিমা, আমার বেহুলা ‘ভাইসা যাক’।
সেই থেকে এই সমুদ্রের মুখোমুখি বসে আছি। আমি ভুলতে পারি না পূর্নিমার সোনারং
শরীরে কালকেউটের ছোবলের দাগ ...।
সালাম লজ্জা আর কুণ্ঠার বোঝা নিয়ে ফিরে যায়। আমি বসে আছি। ঐ তো আমার পূর্নিমা
আলো ছড়িয়ে হাসছে। আমি এখানেই বসে থাকবো বারুদের ¯তূপের মত। উদ্ধত সঙ্গীনের মত,
জ্বলজ্বলে পোস্টারের মত। আমি জানতে চাই আমার দেশ কোনডা ? আমার মাডি কোনডা কত ?’
আমি জানি না আমার এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
|