[প্রথমপাতা] |
বিশেষ প্রতিবেদনঃ জাপানের ট্যাক্সিচালক
সাইফুল ইসলামের কথা

কমিউনিটি
ডেস্ক ।। এপ্রিল ৯, ২০১০ ।।
জাপানে কয়জন বিদেশি ট্যাক্সি চালক আছেন? বিদেশি ট্যাক্সিচালকের ট্যাক্সিতে
উঠেছেন এমন অভিজ্ঞতা বোধহয় খুব বেশি
লোকের নেই। এরকম একজন বিরল বিদেশি
ট্যাক্সিচালক হলেন সাইফুল ইসলাম খান, বয়স ৪০, তিনি রয়েল লিমোজিন টোকিওর
ট্যাক্সিক্যাব চালক। তার জন্ম বাংলাদেশে। ১৯৯৪ সালে তার জাপানে আগমন। ২০০৮
সাল পর্যন্ত তিনি নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। কিন্তু এরপর থেকে শুরু
হওয়া অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে তার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। শুরু করেন
ট্যাক্সি চালনা। জাপানে বিদেশিদের ট্যাক্সি চালানোটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে।
হাতে গোনা কয়েকজন চাইনিজ ও কোরিয়ানদের পাশাপাশি সাইফুল এমন একজন বিরল মানুষ
যিনি এ দেশে ট্যাক্সি চালাতে সক্ষম হয়েছেন।
খান জানালেন তিনি ড্রাইভিং খুবই পছন্দ করেন আর এটা এখন তার পেশাতে পরিনত
হয়েছে। হাস্যজ্জল সাইফুল বল্লেন "সব পথই নতুন পথের যাত্রার মত, যেন আরেকটি
নতুন অভিযান।"
সাইফুল জানালেন, তার লন্ডন ও কানাডায় বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছেন। তিনি
সেসব দেশের যে কোনটিতে সহজেই যেতে পারতেন কিন্তু তার কিছু বন্ধু বল্লেন
জাপানের কথা, এটা নাকি মজার দেশ, যেখানকার লোকজনরা খুব ভাল, বিদেশিদের
থাকার জন্য ভাল স্থান- "শুনেই আমি জাপানে চলে আসি, আর আমার অন্য আরো কিছু
বন্ধু আমার পদাঙ্ক অনুসরন করে।"
সাইফুল ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে আমাদের সংস্কৃতির পোষাক জাপানের বাজারে
নিয়ে আসতেন। এরপর চীন থেকে একই ধরনের পোষাক অনেক কম দামে জাপানের বাজারে
আসতে শুরু করে। আর এই সময় বাংলাদেশ বা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে শুরু
করলে তৈরি পোষাকের দাম বেড়ে যায়। জাপানে এসব পোষাকের দাম কমে গেল আর দেশে
গেল বেড়ে। সুতারাং সাইফুলের আয়ের পথ বন্ধ হবার যোগাড়। তিনি মনে করেন ব্যবসা
যতই ভাল হোক এটা খারাপ হতে সময় লাগে না।
সপ্ন ভেঙে যাওয়াটা দুঃসপ্নের মতই, তবে পরিবারের লোকজন যদি সাহায্য করে তবে
অনেক দুর যাওয়া যায়। সাইফুল বল্লেন তার বয়স যখন ৩৮ বছর, কর্মক্ষেত্রে কেবল
হ্তাশাজনক অবস্থা। তার পরিবার সব সময়ে তার পেছনে ছিল। তাকে উৎসাহ দিয়েছেন
তারা। তার কন্যা তাকে বলেছিলেন "বাবা তুমিতো গাড়ি ভাল চালাও, তবে কেন ক্যাব
চালাচ্ছনা?"
সাইফুলের ভাষায় জাপানি শেখার সেরা উপায় হলো মাংগা (কমিক বই) ও অ্যানিমেশন
মুভি। দুটোতেই ভাল গল্পের উপাদান থাকে আর অনেকটা নোভেল বা সিরিয়াস মুভির
মতই গল্প সাজানো।
ব্লুফিন টুনা নিষিদ্ধ করন প্রসঙ্গে সাইফুল বল্লেন, খাদ্য হলো সংস্কৃতির অংগ।
হাজার বছর ধরে জাপানিরা টুনা খেয়ে আসছে। হঠাৎ করে টুনার উপর নিষেধাজ্ঞাজারী
সমিচীন নয়। এখন যদি বলা হয় "গরুর মাংস নিষিদ্ধ" তবে বিষয়টা কেমন হবে?
"জাপানে গাড়ি চালনা হলো এক উচ্চমাত্রার সেবা প্রদান করা। আমাদের গাড়ি গুলো
হলে লাক্সারীয়াস আর রাস্তাঘাটও সঠিক উপায়ে তৈরি করা আর তার সাথে আমদের
সার্ভিসে রয়েছে পেশাদারিত্ব। আমি একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে গর্বিত,
সেকারনেই আমি আমার পেশাতে আনন্দিত। আমার সহকর্মীরাও পরিবার মতই।"
"জাপানে ক্যাব ড্রাইভার টেস্টে পাশ করতে পেতে একটিমাত্র অতিরিক্ত দক্ষতার
প্রয়োজন -সেটা হলো বিভিন্ন স্থান ভালমত চেনা। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮, এই দীর্ঘ সময়
আমি গাড়িতে করে জিনিসপত্র টোকিওর বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতাম। সে সময় আমার
একটি অভ্যাস ছিল বিভিন্ন বিল্ডিং এর নাম মুখস্থ করা, কনভেনিয়েন্স স্টোরের
নাম আর অবস্থান মনে রেখে দেয়া। কিন্তু কখনো বুঝিনি সেই অভ্যাস ভবিষ্যতে এমন
কাজে দেবে।"
"আমার ছয় বোন ও একটি ভাই আছে। তাদের রয়েছে ১৪টি ছেলেমেয়ে। আমার নিজের আছে
দুটি। সব মিলিয়ে ১৬ শিশু আছে আমার পরিবারে, তাদের সবাইকে আমার দেখাশোনা করতে
হয়। এদের দুজনকে আমি জাপানে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করেছি। তারা এখন এখানে
ব্যবসা করছে। আমি নিজেকে এজন্য ভাগ্যবান মনে করি যে তাদেরকে জাপানের সাথে
সম্পর্ক গড়ে দিয়েছি।"
"আমি যখন এখানে এক মেয়েকে ভালবেসে ফেলি, আমি জানতাম আমার পিতামাতা তা মেনে
নেবেননা। তাই আমি সর্বপ্রথম আমার ছোট বোনকে বলি। সে অন্য পাঁচ বোনকে বলে।
তারা আমার মাকে জানায়। মা জানালেন বাবাকে। এভাবে সবাই বিষয়টা জানল। এক বছর
কেটে গেল কিন্তু তাতে কাজ হলো। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে, আমরা একবার
নববর্ষবরনে ওদের বাসায় গেলাম। সে সময় তাদের প্রায় ৩৫ জন আত্মীয়স্বজন বাসাতে
এসেছিলেন। প্রত্যেকেই আমার প্রতি খুব স্নেহশীল। তবে আমার শশুর বিষয়টা মোটেও
পছন্দ করেননি। আমার জন্য তার মন পাওয়া কঠিন হয়ে উঠলো। আমার স্ত্রীর বোন
উপদেশ দিলেন -তুমি তার সাথে আরো কথা বলো। আমি তাই করলাম। আসলে মেয়েরা জানে
ছেলেদেরকে দিয়ে কাজ পেতে হলে কিছুটা পুশ করতে হয়...।"
"যদি জাপানের সরকারকে পর্যটন খাতে আয় বাড়াতে হয় তাদেরকে অবশ্যই ভিসার বিষয়টি
আরো সহজিকরন করতে হবে। বাংলাদেশের সবচাইতে বড়লোক ব্যক্তিরও অন্তত দেড়মাস
সময় লেগে যায় জাপানি ভিসা পেতে। যদি ভিসা পেতে এত কষ্ট হয় তবে মানুষ স্থির
করবে অন্যদেশে যাবার, এখানে নয়।"
"যখন আমি চিন্তা করি আজকে কেমন যাত্রী পাব, ২০% সময়ে দেখা যায় আমি ভালই
পাচ্ছি। তবে য্খন আল্লাহ্র কাছে দোয়া করি তখন দেখি দীর্ঘ পথের ভাল সংখ্যক
যাত্রীই পাচ্ছি।"
"যখন আমি বিমানবন্দর থেকে বিদেশি যাত্রী নিয়ে উঠি, তারা যখন আমাকে জিজ্ঞাসা
করে আমি কি করে ক্যাব ড্রাইভার হলাম -আমি সাথে সাথেই বুঝে যাই তারা অনেক
বছর ধরে জাপানে আছেন। কিন্তু বিদেশি পর্যটকরা মোটেও অবাক হননা আমাকে দেখে।
কারন অন্যান্য দেশে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের অসংখ্য ক্যাব ড্রাইভার
রয়েছে।"
সাইফুল ইসলামের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে অনেক কাজে দেবে সন্দেহ নেই। ভাল থাকুন
সাইফুল। তিনি এ পথে বাংলাদেশিদের জন্য পথিকৃৎ।
[প্রথমপাতা] |
|