[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

 

 

           যেতে যেতে পথে -১   

 

[টোকিওর বিদগ্ধ লেখক ও সাংবাদিক সজল বড়ুয়া জাপানের বিভিন্ন ঘটনাবলী, প্রবাসীদের সুখ দুঃখ, পরিবর্তনযোগ্য অসঙ্গতি ও বাংলাদেশের নানান দিক সহ চলার পথের নিজের অভিজ্ঞতার কথা এখন থেকে ধারাবাহিক ভাবে কমিউনিটিতে তুলে ধরবেন -তার 'যেতে যেতে পথে' কলামে]

 

 

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের নির্মম 'সড়ক হত্যাকান্ড'র ঘটনায়, ম্যালা প্রশ্নের কারাগারে বন্দী আমরা সবাই

 

সজল বড়ুয়া

 

একাধিক আন্তর্জাতিক পুরুস্কার বিজয়ী খ্যাতিমান বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা 'তারেক মাসুদ এবং বিবিসি'র সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা-প্রসূত ও বাংলাদেশের "সাইমন ড্রিং" খ্যাত সম্প্রচার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ 'আশফাক মুনীর মিশুক' জাতীয় শোক দিবসের ঠিক দু'দিন আগে 'আনলাকি থার্টিন' বা ১৩ আগষ্ট '১১ দুপুর বারোটায়, ঢাকার অদূরে, মানিকগঞ্জের 'জোকা' মোড়ে আকস্মিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্য তিনজন সহযোগিসহ ঘটনাস্থলেই নির্মম ভাবে নিহত হন। এ ঘটনার পরদিন রাতেই টোকিওর বিভিও হলে, বাংলাদেশ সাংবাদিক লেখক ফোরাম -জাপান তড়িত্গতিতে আটপৌরে এক শোকসভার আয়োজন করে, যাতে আশাতীত উপস্থিতি ছিল সত্যিই লক্ষ্যনীয়।

অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী 'বাংলাদেশের সম্পদ' এ দু'জন কৃতী ব্যক্তি মূলতঃ বিদেশেই বসবাস করতেন। তারেক মাসুদ আমেরিকার ঝলমলে প্রাচুর্য পদদলিত করে, ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্পে স্বদেশে ফিরে আসেন সস্ত্রীক। অসাম্প্রদায়িক সমাজ, প্রগতিশীল রাষ্ট্র, কুসংস্কারহীন জনগোষ্ঠী, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস- ইত্যাকার বিষয়বস্তুকে মনে-প্রাণে ধারণ করে, তিনি সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন -অতুললীয় কিছু প্রামাণ্যচিত্র সহ মূল্যবান চলচ্চিত্র। বাংলাদেশে অনেকেই তখন সবিস্ময়ে দেখেছেন -এই মহৎ কর্মকান্ডে একজন বিচক্ষন সহকর্মি হিসেবে তাঁরই নিত্যসঙ্গী ছিলেন -তারেক মাসুদের জীবনসঙ্গী আমেরিকার নাগরিক ক্যাথেরিন মাসুদ। অন্যদিকে, মিশুক মুনীর কানাডার 'দি রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক' এর মতো পৃথিবীখ্যাত গণ-মাধ্যমের মর্যাদাবান চাকুরি ত্যাগ করে, নিজেরই বাবা সুপরিচিত শহীদ মুনীর চৌধুরীর মতোন মাতৃভূমিকে বিরল কিছু দেয়ার অভিপ্রায়ে, আট মাসে আগে তল্পিতল্পাসহ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সম্প্রতি উল্লেখিত দু'জন বিখ্যাত মানুষের 'চিরকাল ফিরে না আসার দেশে' অসময়ে চলে যাবার মর্মান্তিক ঘটনা, আমাদের সবাইকে জ্বলন্ত অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়, পাঁচ জনের মৃত্যুর ক'দিন পর বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন একই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মাহমুদা জলিকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে দেখতে যান। সেখানে এক পর্যায়ে মন্ত্রী মহোদয় তারেক মাসুদের অন্যতম চলচ্চিত্র-নির্মাণ সহযোগি বিছানায় শুয়ে থাকা যন্ত্রণাকাতর জলিকে উদ্দেশ্য করে, স্মিত হেসে বলেন-"আমি বিভিন্ন ভাবে জানতে পেরেছি -সেদিনের দুর্ঘটনায় আপনাদের মাইক্রোবাসের ড্রাইভারেরই দোষ ছিলো।" কান্ডজ্ঞানহীন অমানবিক এই মন্ত্রীর আপত্তিকর উদ্ভট উক্তির পরপরই, স্বদেশ সহ প্রবাসের বাঙালি মহলেও বহুমুখী আলোচনায় তোলপাড় শুরু হয়।


যোগাযোগ মন্ত্রীর অভিন্ন সুরে 'পরিবহন ব্যবসার সম্রাট' খ্যাত নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানও এরপর বলতে শুরু করেন -"অশিক্ষিতদের লাইসেন্স না দিয়ে উপায় নেই। চালক মানুষ আর গরু-ছাগল চিনলেই হলো।" পরবর্তীতে "বাংলাদেশের বিভিন্ন রাস্তাঘাট খুব একটা খারাপ নয়" -যোগাযোগ মন্ত্রীর আরেক অবাস্তব কথার পর, পরিস্থিতি আরো বেসামাল হয়ে গেলে, প্রধানমন্ত্রীর টনক নড়ে উঠে। তিনি উপরোক্ত দুই মন্ত্রীকে ডেকে কড়া ভাষায় তিরস্কার সহ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার ঈদের ছুটি বাতিল করে, কঠোর নির্দেশ দেন -"আসন্ন ঈদের আগেই সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো যে কোন মূল্যে চলাচলের প্রকৃত উপযোগি করে তুলতে হবে।" আর এর ঠিক পরপরই যোগাযোগ মন্ত্রী চটজলদি প্রথমেই ছুটে যান- ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পরিদর্শনে। কিন্তু কপাল-পোড়া সেই মন্ত্রী সেদিনই ঢাকায় ফেরার পথে, রাস্তার দুরবস্থার কারণে তিনি নিজেই পথিমধ্যে আটকে থাকেন প্রায় দু'ঘন্টা। পরদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তোপের মুখে নির্লজ্জ সেই মন্ত্রী আবারও শুরু করেন মিথ্যাচার -"এ বছর সবচে' বেশি বৃষ্টি হওয়ায়, বেশিরভাগ রাস্তাঘাটই ভেঙে গেছে।" এ ভাবে ক্রমান্বয়ে নানান দিকে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলে, যোগাযো্গ মন্ত্রনালয়ের ৭ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বদলিও করা হয় বেশ কয়েক জনকে। উপরন্তু স্বেচ্ছায় অবসরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন -সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলি শাহাবুদ্দিন। কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই ব্যঙ্গাত্মক উক্তি- "যোগাযোগ মন্ত্রীর মুখ প্রতিনিয়তই উজ্জ্বল, অথচ দেশের রাস্তাঘাট দীর্ঘকাল এতো করুণ কেন?" এবং সংসদসহ বিভিন্ন সচেতন মহলে মন্ত্রীদ্বয়ের পদত্যাগের কথা জোরালো ভাবে উঠলেও, বাস্তবে দেখা গেছে -তারা দু'জন মন্ত্রীত্ব ধরে রাখার লোভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমন তুলকালাম পরিস্থিতিতে, ১৩ আগষ্টের সেই ঘাতক বাস ড্রাইভার -'জামির' পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর, তদন্তে জানা যায়- প্রকৃতপক্ষে সেই ড্রাইভারের 'ড্রাইভিং লাইসেন্স'ই ছিলোনা। এ'দিকে বনানীতে লাশ দাফনের পর, মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী মানববন্ধনের এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের বলেন -'বিরোধী ও সরকারী দল বিভিন্ন সময়ে সামান্য কারণে দেশের জন্য মহা ক্ষতিকর 'হরতাল' ডাকেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বা নিরাপদ সড়কের মতো জরুরী বিষয়ে তারা দু'দলই কোনোদিন 'হরতাল' ডেকেছেন, তেমন কোনো নজির নিকট অতীতের ইতিহাসে নেই। একই সাথে মঞ্জুলী কাজী বিশেষতঃ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখসহ রাজনীতিবিদদের কঠোর ভাবে দায়ী করে, দৃপ্ত কন্ঠে সেদিন আরো বলেন- "আপনাদের কাছে আমরা দেশের জনগণ এখন মহা-বোঝা। তাই দয়া করে একটা বোমা মেরে, আমাদের সবাইকে আপনারা মেরে ফেলুন"

উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (
WHO) এর এক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায় -বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর 'সড়ক দুর্ঘটনা'য় প্রতি বছর বিশ হাজার মানুষ নিহত হন। সেই হিসেবে দৈনিক ৫৪ জনেরও বেশি স্বদেশে মারা যাচ্ছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, যা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনে, আমরা রীতিমতো আঁতকে উঠি। পাশাপাশি, বাংলাদেশে আজকাল অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরাও 'হৃদ-কম্পন' সৃষ্টিকারি এই সড়ক দুর্ঘটনাকে 'জাতীয় দুর্যোগ' হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন, যা আমাদেরকে রীতিমতো 'দুঃশ্চিন্তার গভীরে' বন্দী করে।

অন্যদিকে গেল ১৫ আগষ্ট '১১ এর দৈনিক 'কালের কন্ঠ' এর সম্পাদকীয়তে আশঙ্কা করে বলা হয়েছে -মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার এমন সব প্রতিভাবান ব্যক্তিদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে প্রতিক্রিয়াশীল কোন শক্তি কোন ভাবে কাজ করছে কিনা - সে বিষয়েও সূক্ষ তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

সচেতন সুপ্রিয় পাঠক, আমার বিশ্বাস, উপরোক্ত স্পর্শকাতর মৃত্যুর মহোত্সব বিষয়ে কম-বেশী আপনাদের সবারই ধারণা আছে। তারপরও আজকের এই ক্ষুদ্র লেখার মাধ্যমে, 'সড়ক হত্যাকান্ড' বাংলাদেশে চিরকালের জন্য নির্মুল কল্পে, ব্যস্ততম পরবাসেও আমাদের প্রত্যেকের এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে না যাওয়া 'সচেতনতা সহ করণীয়' বিষয়ে সজাগ থাকার জন্যে সবিনয়ে আমি আবেদন জানাই।

২২ আগষ্ট '১১
sajalbarua@gmail.com


 

 

[প্রথমপাতা]