[প্রথমপাতা] |
-মুরগী ধরা-
বাকের মাহমুদ
মুরগী গৃহ পালিত, পাখি হলেও খুব একটা ওড়াউড়ি জানেনা। গৃহের মানুষদের
কাছাকাছি থেকে প্রভুর দেওয়া খাবারে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে যেন সদা প্রস্তুত থাকে,
প্রভু চাহিবা মাত্র জবাই করতে পারে।বাড়ীতে অতিথি এলে ঝট পট একটা ধরে জবাই
করে অতিথি সেবা করা সহজ। গৃহে পালিত মুরগী যাওবা একটু লম্প ঝম্প জানতো,
আধুনিক ফার্মের মুরগী একেবারেই জানেনা এদের ধরা খুবই সহজ। স্থান কাল ভেদে
মুরগী ধরারও রকম ফের আছে, বাংলাদেশে বই প্রকাশনা জগতে এরকম একটা কথা চালু
আছে,সেটাকেও মুরগী ধরা বলে।
প্রকাশকরা সকলে শুধু মাত্র ব্যাবসায়ী নয়,অনেকে আবার বুদ্ধিজীবি হিসেবেও
খ্যাত। যারা নবীন লেখক তাদের বই কি, কেমন, সেটা মোটেই বিষয় নয়,বিষয় হলো তারা
সবাই মুরগী। টাকা দিলে লেখা যাই হোক প্রকাশ হবে,না হয় হবেনা। যাদের লেখক
খ্যাতি আছে তাদেরও লেখা কেমন সেটা মোটেই বিবেচ্য নয়, যা পাবে তাই প্রকাশ
করবে। অবশ্যই সবাই এক রকম নয়। কিন্ত বেশীর ভাগই নূতন লেখকদেরকে মুরগী বানায়।
বুদ্ধিজীবিরা মুরগী ধরে রাজনৈতিক দল,এন জি ও,ধনী দেশ,বড় প্রতিষ্ঠানকে।
বাংলাদেশে অনেক বুদ্ধিজীবির আছে দলীয় পরিচয়। এরা দূর্নীতিবাজ নেতার পক্ষে
শুধু বলে নয় লিখেও সাফাই গায়।
অনেক লেখক,নাট্যকার,কবি,প্রবন্ধকার, সাংবাদিকের কপালেও আছে রাজনৈতিক তিলক।
তাদের দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। কেউ আবার দীর্ঘ
দিনের গায়ে লেগে থাকা সাংবাদিকের ছাল ঝেড়ে ফেলে আলাদা গর্বের অধীকারি হন।
এদের নাম এত উপরে যে সাধারন মানুষের থু থু অত উপরে যায়না বলে তারা নিজেদেরকে
সবার পুজনীয় ভাবে। দল ক্ষমতা হারালেও এসব সাংবাদিক,বুদ্ধিজীবিদের তেমন কিছু
হয়না। আর আহমেদ ছফার মত কোন লেখকও নেই যে,নিজে সৎ থেকে এদেরকে নিয়ে গাভী
সমাচার লিখবে। অনেকে আবার বিভিন্ন পত্রিকার বিভিন্ন স্থানের স্থানীয়
প্রতিনিধি পরিচয়ে সমস্যাগ্রস্ত লোকদেরকে মুরগী ধরে। জমি নিয়ে
বিরোধ,মামলা,হামলা,দখল এসব ক্ষেত্রে সুবিধা বেশী। অবশ্য এরকম মুরগী এখন
রাজনীতিক নেতারাও ধরে, ঈদে নেতারা ব্যাবসায়ীদের কাছে চিরকুট পাঠায়, একশ পিস
লুঙ্গি পাঠান। দরিদ্রদের জন্য জাকাতের কাপড়ও আজ কাল মুরগী ধরে নেয়
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
পত্রিকা প্রকাশনাও অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগের হাতিয়ার। বেশির ভাগ পত্রিকার
মালিক ব্যবসায়ী, নেতা। পত্রিকায় লেখা লেখির মাধ্যমে তৈল মর্দন অত্যন্ত
ফলপদ,এ মহৌষধ অনেক জায়গায় ব্যাবহার হয়। আমলা, মন্ত্রী,নেতা থেকে ক্ষমতার
শীর্ষ পর্যন্ত। লেখা ছাপাতেও তৈল বহু উপকারি,শ্রী হর প্রষাদ শাস্রীর তৈল
সমাচার এতটা সার্থক যে তিনি যেখানেই থাকুন,মুচকি হাসছেন। বাংলাদেশে শত করা
৯৫% লেখা ছাপা হয় ব্যাক্তি পরিচয়ে অথবা উপরি কিম্বা উপটোকন দিয়ে। এ বিষয়ে
বেশ কিছু দিন আগে শ্রদ্ধেয়া শাহিন আক্তার কিছু বাতেনি কথা জাহির করেছিলেন।সাংবাদিক
সমাজে যে ক’জন সাহসী আছেন তারাও দেখি অজ্ঞাত কারণে চুপ। নতুন লেখিয়েদের লেখা
পত্র পত্রিকায়ও চোখে পড়ে না বললে খুব বেশী বলা হবেনা মোটেই। পুরো দেশে
সাহিত্য পত্রিকা খুঁজতে দূরবীন লাগবে,তারাও চাপে প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা।
বলা বাহুল্য, যেসব প্রতিষ্ঠিত লেখক বৎসরে দশটা উপন্যাস,পাঁচটা নাটক,সতরটা
প্রবন্ধ, একুশটা ছোট গল্প লিখেন এবং বৎসরে আশিটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে
বক্তব্য বা প্রবন্ধ পাঠ করেন। তারা কয়েকজন নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ লেখক
সমাজ,বাংলা দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার মত করে বাংলা সাহিত্যকেও পৃথিবীর
মানুষের কাছে পরিচিত করবেন বলে আশা করছি। লেখালেখি আবার কারো পারিবারিক পেশা
হয়ে গেছে, তাদের বাসার কাজের লোকের লেখাও প্রকাশ করার জন্য প্রকাশকের অভাব
হবেনা। অবশ্য রাজনীতিও আমাদের দেশে পারিবারিক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।সেখানে
আবার বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য্য, ব্যারিষ্টার,বুদ্ধিজীবি,বিখ্যাত
সাংবাদিক,দল প্রধানের পদ চুম্বন করে ধন্য হন।
আরেক ধরনের মুরগী ধরা আছে,এ মুরগীরা লেখক নয়,দু’একজন হয়তো পাঠক। এরা হলো
প্রবাসী বাঙ্গালী। ফার্মের মালিকরা যেমন মুরগীর ডিমটা দেখে,দেশের লোকরাও
প্রবাসীদের টাকাটা দেখে। আপন পর কেউ দেখেনা তাদের সুখ, দূঃখ,আবেগ,অশ্রু।ঋত্বিক
ঘটকের মেঘে ডাকা তারার সেই মেয়েটার মত বাঙ্গালী প্রবাসীরা। যার আয়ে সবার
শ্রীবৃদ্ধি হয়, আর সে নিজেই অবহেলিত হয়ে রয়। যথা সময়ে অনেকের বিয়ে হয়না,
নিকটজন হীন প্রবাসের ক্লান্তিতে যদি অসুস্থ্য হয়, তার সংঙ্গী হয় দীর্ঘশ্বাস।
অনেকে দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকায় দেশের ধোঁকাবাজী চাটুকারী বুঝতে পারেনা,
দেশের প্রতিবেশী যুব সমাজ, দেশে না থাকায় চেনেনা আর তাই নিজ দেশেও তারা
প্রবাসী। অনেকে প্রবাস জীবনের ইতি টানতে দেশে এসে ব্যাবসা করতে গিয়ে সারা
জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে পথে বসার উপক্রম হয়। নিজ দেশে খাপ খাওয়াতে নাপেরে
সর্বশান্ত হয়ে আবার বিদেশ পাড়ি দেয়। বিমান বন্দরের কাষ্টম,ইমিগ্রেশান
অফিসার অনেকে প্রবাসীদের সাথে ঠাটারী বাজারের কসাইদের চেয়ে খারাপ ব্যাবহার
করে। লন্ডন প্রবাসী চুরত আলীর কাছাকাছি পরিণতির উদাহরন অনেক। অথচ বর্তমান
মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কষ্টের কথা পত্রিকায় পড়ে বিবেকবান মাত্রই হৃদয়
ভারাক্রান্ত হয়। হয়না শুধু কিছু দূতাবাস কর্মকর্তার। আর আদম বেপারীদের তুলনা
চলে হায়েনার সাথে। আমন ধান রোপা শেষে সামান্য কিছু জালা যদি বেঁচে যায় কৃষক
সেগুলো পুকুরের পাড়ের কাছে পানিতে রেখে দেয়। সে জালা আলো বায়ু পানি সব পায়
তবু আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। কারণ তারা প্রবাসী বাঙ্গালীদের মত,
নাপারে যেখানে আছে সেখানকার মাটিতে শিকড় বিস্তার করে ডাল পালা গজাতে,না পারে
পূর্বের মাটিতে ফিরে যেতে। তাদের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরন রয়ে যায় সভ্য সমাজের
আড়ালে।
দেশের অনেক বড় লোক, বুদ্ধিজীবি,শিল্পী,আমলা বিভিন্ন কারণে বিদেশ যায়,গিয়ে
মুরগী ধরে, এ মুরগীরাও প্রবাসী। এদের কেউ কেউ সাংষ্কৃতিক মনা,অনেকে
আবেগাশ্রয়ী। যারা বেড়াতে গিয়ে এদের সহায়তা নেয়, তাদের ৯০ ভাগ মুরগী ধরা। আর
প্রবাসীরা যা দেবার তা উজাড় করেই দেয়, কিছু মাত্র কার্পন্য না করে এবং ভাবে
বেড়াতে আসারা আমাদের দেশের মান্যগন্য মানুষ, তাদের জন্য কিছু করতে পারাও
ভাগ্যের ব্যাপার। প্রথমেই বলেছি, সবাই এক রকম নয়,তবে বেশীর ভাগ বেড়াতে আসা
ভদ্রলোকরা দেশে যদি কখনো ঐ প্রবাসী লোকটা কোন প্রয়োজনে দেখা করে,এত ব্যস্ততা
দেখায় যেন মরারও সময় নেই ওনার। অনেক বড় কর্তা আবার আশ্বাস দিয়ে ঘুরায়। আর
বাংলাদেশের বড় কর্মকর্তাদের কর্মের কাহিনী দুনিয়ার লোকের কৌতুকের খোরাক
জোগায়। পর পর পাঁচ বার দুর্নীতিতে শ্রেষ্ঠ হবার গৌরব তো আর এমনি এমনি পাইনি
আমরা। আবার সাপ্তাহে সাড়ে তিন দিন পৃথিবী থেকে দাপ্তরিক কাজে বিচ্ছিন্ন
থেকেও আমাদের দেশের আমলারা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়। তারা মুরগী বানায়
ফাইলকে, এক একটা ফাইল মানে বড় বড় তাজা মোরগের মত,জিহ্বায় লালা আনে।
দেশে গেলে প্রবাসী দেরকে, গ্রামের বা পড়ার ছোট ভায়েরা দাওয়াত করে চা মিষ্টি
খাইয়ে সর্ন্মান সহকারে অনুরোধ করে, তাদের ক্লাবের একটা ষ্টীলের আলমারি অথবা
একটা টেলিভিশন কেনার জন্য বিশ হাজার,(ক্ষেত্র বিশেষে পঞ্চাশ হাজার,লাখ) টাকা
দেওয়ার।চাঁদাবাজদের বড় টারগেট হয় প্রবাসীরা। প্রবাসী অনেকেই গ্রামের গরীব
কারো মেয়ের বিয়ের যৌতুক,কারো চিকিৎসা, অভাবে নগদ টাকা, কাপড় দেওয়া, এসব
সমাজ সেবা করতে হয় বাধ্য হয়ে। এমন কাউকে কি পাওয়া যায়, যে জিজ্ঞেস
করে,বিদেশে নিকটজন হীন কর্ম ক্লান্ত একঘেঁয়ে জীবনে কেমন ছিলিরে?
নুতন পরিচিত অনেকে প্রস্তাব দেয়, টেলিভিশনের টক শোতে সুযোগ করে
দেবার অথবা পত্রিকায় সাক্ষাতকার ছাপার নামে মুরগীধরার। আমাদের দেশে
রাজতন্ত্র নয় গনতান্ত্রিক শাষন ব্যাবস্থা,তবে পারিবারিক গনতন্ত্র।
সমর্থকরাও প্রাণ দিয়ে এই পারিবারিক ধারাবাহিকতার পক্ষে চিৎকার দিয়ে গলা
ফাটায়। প্রয়োজনে গালাগালি,মারামারি সব করতে পারে। এতে লাভ নগদ,যায় যদি যাক
প্রাণ দল প্রধান ভগবান। এক বিয়ের পাত্র কি করে জানতে চাইলে,ঘটক উত্তরে
বলে,আগে বেকার ছিল এখন বি এন পি করে। এ ঘটনা পাঁচ বৎসর আগের। এখন আওয়ামী
লীগেও এ কর্ম, গর্ব করে পরিচয় দেওয়ার বিষয়। পার্টির কাজে আত্মীয়রাও রাত দিন
খাটে। এমপির ছেলে, জামাই এমনকি শালীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে পার্টির জন্য।
কুষ্টিয়ার দিকে একটু বেশী করে। জলপাই রং এর পোশাক পরে আসা রমণীমোহন এখন
জীবন সায়ান্নে এসে করুণা ভিক্ষা করছে। হানাদারের দোসর পিশাচরা করছে
মুক্তিযুদ্ধের বন্দনা। পলায়ম্পর সচেতন যুব সমাজ, বিদেশে গিয়ে কেউ হচ্ছে লাশ,
এ আমাদের পরিবারতন্ত্রের নির্মম পরিহাস। জয়তু মুরগী ধরা।
bakermahmud@yahoo.com
>>ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা এবং লালন দর্শন
[প্রথমপাতা] |
|