প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

চাঁন্দে সেদিন সভা বসছিলো

 

--- শিল্পী নাজনীন ---

 


আকাশ দেখা হয় না কতদিন! কতদিন হয় না মেঘেদের ভেলায় মন ভাসিয়ে পাখির মত শূন্যে ওড়া! জীবন তবু বয়ে চলে । বয়ে চলে নদী । নদী আর নারীর বহমানতায় মুগ্ধ, বিমোহিত হওয়ার ফুরসত আজকাল আর মেলে না কানন এর । জীবনের ক্রীতদাস হয়ে সকাল সন্ধ্যে সে বিক্রি হয়ে যায় প্রাত্যহিকতার কাছে । সাত সকালে ছুটতে হয় অফিসে । ফিরতে ফিরতে রাত । অফিসের কাঁচঘেরা জানালা দিয়ে যদি বা ফিকে আকাশ দেখা যায় কিন্তু তাকানোর অবসর নেই, ইচ্ছেও মরে গেছে । এখন তাই আকাশের দিকে তাকালে বরং অচেনা লাগে খুব । মাথা ঘুরে ওঠে । যেন হঠাৎ দেখা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার অস্বস্তি ভর করে ।
আজ তবু কি মনে করে তাকালো । কিংবা হঠাৎ ফুরসত মিলে গেল অনেকদিন পর । অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়েছিল কানন । সন্ধ্যেটা অনেকদিন পর হাতে পেয়ে কেমন বোকা বোকা লাগছিল নিজেরই । কি করবে ভেবেই নষ্ট করে ফেলল অনেকটা সময় । কৃপণ যেমন আগলে রাখে তার ধন তারপর হুট করে মৃত্যু এসে কাছে দাঁড়াতেই নিদারুণ আফসোসে হা হুতাস করে, ভোগ না করে মিথ্যে আগলে রাখার বোকামীতে কষ্ট পায়, তেমনি নষ্ট সময়টা ভেবে কাননেরও ভারী আফসোস হল । একটু কষ্টও । অস্থিরতা ঘিরে ধরল । তার এমন কোনো বন্ধু নাই যেখানে যাওয়া যায়, কাটানো যায় এই সন্ধ্যেটা । কিন্তু এতদিন পর এই একটা সন্ধ্যে তার নিজের করে পেলো, কিছুতেই এই সন্ধ্যেটা সে মাটি করতে চায় না । ঘড়ি দেখল কানন । অস্থিরতা বেড়ে গেল আরও । সাড়ে সাতটা । সাড়ে এগারোটায় তাকে ফিরতে হয় বাসায় । সাড়ে এগারোটায় বাসার মেইন গেটে তালা পড়ে যায় । এরপর বাসায় ঢোকা মানে আপা দুলাভাইয়ের তোপের মুখে পড়া । আবাস গুটিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার তাগাদা । হাতে আছে ঘণ্টাচারেক সময় । এই সময়টা সে আজ উপভোগ করতে চায় । একটা রিক্সা খালি পেয়ে হাত ইশারায় ডাকে কানন ।
কই যাইবেন?- প্রশ্ন করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে রিক্সাওয়ালা । কথা বলে না কানন । লাফ দিয়ে উঠে বসে । পায়ের উপর পা তুলে যুত করে বসে প্রায় আদেশের সুরে বলে- চালাও!
কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় টান দেয় রিক্সাওয়ালা । কানন দুহাতে বাতাস আড়াল করে কায়দা করে সিগারেট ধরায় । বেনসন এন্ড হেজেস । সে নিজে খায় গোল্ডলিফ । আজ দিন ভাল ছিল । দাঁও বুঝে বসের রুম থেকে ঝেড়ে দিয়েছে এক প্যাকেট । দারুণ সুখে সে ধোঁয়ার রিং তৈরীর চেষ্টা করে । ধোঁয়া বেশ পাক খেতে খেতে শূন্যে উড়াল দেয় । চোখ সরু করে দেখে কানন । ঠোঁটে গুঁজে রাখা সিগারেটে টান দেয় আবার । তার পরনে ধোপদূরস্ত জিন্স । গায়ে বাহারি টি শার্ট । পায়ে কেডস । তাকে দেখে কেউ বুঝবে না সে এমনকি কলেজের গন্ডিটাও পেরোয়নি । ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়ই ঘটে গেল ঘটনাটা । সেই থেকে সে গাঁ ছাড়া । লাপাত্তা । পুলিশের ভাষায় পলাতক । পড়াশোনা আর এগোয়নি । এমনিতেও অবশ্য খুব জ্ঞানপিপাসু সে ছিল না কোনোকালেই । হঠাৎই আকাশের দিকে তাকালো কানন । তাকিয়েই বুকের মধ্যে কেমন ধাক্কা লাগল । আজ কি পূর্ণিমা? ধুস শালা! জোরেই বলে ওঠে কানন । রিক্সাওয়ালা পিছন ফিরে বলে ওঠে- কি কন?যাইবেন কই?
যেই খানে মন চায় যামু । তুমি যাইতে থাকো!- ধমকের সুরে বলে কানন । রিক্সাওয়ালা ছেলেটাকে লক্ষ্য করে । তারই বয়সি হবে । পঁচিশ ছাব্বিশ । লুঙ্গি পরা, ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়ে চটি । মাথায় একটা গামছা ফেট্টি করে বাঁধা । আবার আকাশের দিকে তাকায় । চাঁদটা কেমন নির্লজ্জের মত হাসে । তার চারপাশে গোল আগুনের চাকতি । কিংবা রংধনু । চাঁদের থেকে কিছুটা দূরত্বে বৃত্ত তৈরী করেছে । চাঁদের উপর দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আবার কাছে আসছে । যেন চাঁদটাকে কেন্দ্র করেই মেঘগুলোর পরিক্রম চলছে আজ । মাকে মনে পড়ে যায় । মনে পড়ে এমনি চাঁদনি রাতে মা তাদেরকে নিয়ে উঠোনে পাটি পেতে বসতেন । গল্প শুনাতেন । তালপাখার বাতাস খেতে খেতে হঠাৎই বলে উঠতেন- দেখ! দেখ! চাঁন্দে সভা বসচে আজ!
কানন আর তার ভাইবোনেরা হৈ হৈ করে উঠত । আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত । চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠত তাদের মুখগুলো । কানন চাঁদের দিকে তাকাতেই গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠত তার । মায়ের আরও কাছটিতে ঘেঁষে বসে সে প্রায় ফিসফিস করে বলত- চাঁন্দে কেমনে সভা বসে, মা?
মা বুঝতেন কাননের অনুভূতি । কাননকে কাছে টেনে মা বিজ্ঞের মত বলতেন চাঁন্দের কাছে আজ বেবাকতারারা চইলা আসচে, তারা বেবাকে মিল্যাচাঁন্দের লগে সভা করব, দেহস না, চাঁন্দের আজ কত রূপ ফুটচে? বেবাকের আলো আজ চাঁন্দের উপরে পড়চে, তাই আজ তার এত জৌলুস ।
মায়ের জ্ঞানগম্যিতে অবাক কানন ফ্যালফ্যাল করে একবার মা আর একবার চাঁদের দিকে তাকাতো । গা শিউরানো ছমছমে এক অনুভূতি জাপটে ধরত তাকে ।
কাননের মতিগতি সুবিধার ঠেকে না রিক্সাওয়ালার । বেশ রাত নেমেছে এখন । ঘরে তার পোয়াতি বউ । বেশি রাত রিক্সা চালায় না সে । সে তাই নিশ্চিত হতে চায়, ঠিক কোথায় যাবে আরোহী ব্যক্তিটি, কত রাত হতে পারে তার ফিরতে । অধৈর্য্য হয়ে তাই সে আবার জানতে চায়- ভাই, আপনে যাইবেন কই কন! আমি বেশিদূর যাইতাম না । বাসায় ফিরতে অইবো জলদি ।
রাতের এইসব মাথা আউলা আরোহীদের সে বেশ ভয় পায় । এরা বিপজ্জনক হয়, সে জানে । কানন, কেন কে জানে ভারী উদার হয়ে ওঠে হঠাৎ । উদাস উদাস গলায় বলে- বাসায় ফিরতে অইবো তোর? আহারে! এক কাম কর, আমারে সামনে যে বেড়িবাঁধটা আছে অইহানে নামাইয়া দে । তারপর তোর যেইহানে মন চায়, যাগা, যা!
বেড়িবাঁধের নির্জন বাঁধানো ঘাটে থম ধরে বসে থাকে কানন । মরা নদীটায় চাঁদের আলো পড়ে কি অদ্ভুত দেখায়! আবার আকাশের দিকে তাকায় । আকাশে আজ তার মায়ের ভাষায় ‘চাঁন্দের সভা বসচে’ । আগুনরঙা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কেমন একটু চাপ অনুভব করে । কেমন দমবন্ধ একটা অনুভূতি টের পায় । তারারা কেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলে । মায়ের নাকের নাকফুলটি হয়ে ফুটে থাকে আকাশের গায়ে । কাননের চোখ জ্বালা করে । মা! তার বোকাসোকা, ভালমানুষ মা! আকাশের কোন তারাটি হয়ে আছেন এখন কে জানে!
ভারী ঠান্ডা বাতাস বয় । শহুরে ব্যস্ততা তেমন নেই এই রাস্তাটায় । বেড়িবাঁধের এই রাস্তাটা বাইপাস হিসেবে ব্যবহৃত হয় । ভীড় বেশ কম । সন্ধ্যার পর বেশ নির্জন । শুকনো, মরা নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় গ্রামের পাশ দিয়ে ঝিরঝির বয়ে যাওয়া নদী । আহা! কতদিন যাওয়া হয়নি! কতদিন বসা হয়নি তার প্রাণ জুড়োনো তীরে! হঠাৎই মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে । মনে পড়ে যায় বিপ্লব ভাইয়ের মুখ । হাত মুঠিবদ্ধ হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই । দাঁতে দাঁত পেষে । বিড়বিড় করে- শালা! শুয়োরের বাচ্চা!
আত্মগ্লানিও হয় বৈ কি! নিজেরও ভুল ছিল তার । ছিল লোভ । কিন্তু সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না তার জন্য । আঠারো বছর বয়সে অমন লোভ হতেই পারে । সালটা ছিল দু হাজার নয় । ফেব্রুয়ারি না কি মার্চ? মার্চই হবে, সম্ভবত । ঠিক মনে নেই । গ্রামে দিন, মাস, তারিখের খবর অত রাখে না কেউ । একদিন অনেক রাতে দরজায় কড়া নড়ে উঠেছিল তাদের । কানন বা তার ভাইবোন, টের পায়নি কেউই । বাবা খুলে দিয়েছিলেন দরজা । সকালে ঘুম ভেঙ্গে তারা দেখেছিল বিল্পব ভাইয়ের ফর্সা, ফোলা মুখ । বহুদিন বিপ্লব আসেনি তাদের তল্লাটে । অন্তত বুদ্ধি হওয়ার পর দেখেনি কানন । বিপ্লবকে দেখে তাই ভারী অবাক হয়েছিল তারা । বিপ্লব ভাই তেমন পড়াশোনা করেনি । ক্লাস এইট অব্দি পড়েই যোগ দিয়েছিল বিডিআর বাহিনীতে । তাদের গ্রামও অনেকটা দূর কাননদের গ্রাম থেকে । সে কারণে কাননদের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না । চাকরির পর আরও দূরত্ব বেড়েছিল । মাঝে মাঝে, ছুটিছাটায় যদি বা নিজ গ্রামে যেত বিপ্লব, কাননদের বাড়িতে যাওয়া আর হয়ে উঠত না তার । মা আফসোস করে বিপ্লবের মাকে বলতেন- তোমার পোলা তো আর তার খালারে চিনেই না বুজি! চাকরি পাইয়া পর কইরা দিল তারে!
বিপ্লবের মা পান মুখে পুরেহাসতেন । সুখের হাসি, তৃপ্তির হাসি । হাসতে হাসতে বলতেন- কি যে কইস ছোট! বিপ্লব তোরে কত্ত বালাবাসে! আইলেই তোগো কতা জিগায় । সুময় করবার পারে না, তাই যাইতে পারে না রে পাগলি! সরকারি চাকরি, কত কাম তার বুজিস নে!
শেষের কথাগুলো বলার সময় বড় খালার মুখটা কেমন উজ্জ্বল, অহংকারি হয়ে উঠত! ভারী অবাক হয়ে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত কানন । একজন মানুষ কি পরিবেশ, পরিস্থিতি, সময় আর স্থান অনুযায়ী বদলে যায়?বদলে যায় তার কথা বলার ঢং, মুখের অভিব্যক্তি আর চেহারার আদল? বড় খালাকে দেখত আর নিজের মনে কথাগুলো নিয়ে বেশ উল্টেপাল্টে ভাবত সে । ঘুম ভেঙ্গে সেই বিপ্লব ভাইকে দেখে তারা তিন ভাইবোন অবাক হয়েছিল বেশ । খুশিও । সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন মা । এতদিন পর বেড়াতে আসা বোনপোকে তিনি কোথায় বসাবেন, কি খাওয়াবেন, ভারী অস্থির হয়ে উঠেছিলেনসে চিন্তায় ।
কিন্তু বিপ্লব ভাইয়ের আচরণ ছিল কেমনধারা । বেশ আনমনা হয়ে থাকত । সামান্যতেই কেমন চমকে চমকে উঠত । বাড়ির বাইরে তেমন একটা বের হতো না । কানন তখন খুব ছোট তো নয় । ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার । উড়ুউড়ু মন তার । সিনেমা, নাটক, টিভির নেশা । সে বিপ্লব ভাইয়ের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলো । তার সাথে আলোচনা করে নিজের জ্ঞানগম্যি একটু ঝালাই করতে চাইল । চাইল রুবির বিষয়টা নিয়েও একটু শলা পরামর্শ করে । হাজার হোক সরকারি চাকরি করা শহুরে ভাইটি তার । তার মতামতের একটা দাম তো থাকেই! রুবির সাথে বেশ জমে গেছে তার তখন । আড়ালে পেয়ে বেশ কবার চুমুও খেয়েছে সে । বেশ মেয়েটি । এইটে পড়ে! কিন্তু বিপ্লব বড় পাত্তা দেয় না তাকে । পড়ে পড়ে ঘুমোয় । সামান্য শব্দ হলেই চমকে ওঠে, লাফ দিয়ে উঠে বসে লাল চোখে ভয়ে ভয়ে জানতে চায় কি হয়েছে, শব্দ কিসের! কেমন খটকা লাগে কাননের । এ কেমন ধারা মানুষ! দিনে ঘর থেকে বেরোয় না, কারও সাথে কথাও বলে না তেমন, কতদিন পর এবার এল, এল যদি তো যাবারও নামটি নেই! অথচ মার কত অনুরোধ, উপরোধেও বিপ্লব কখনো এমুখো হয়নি! এখন কি তার চাকরি নেই? অনেকগুলো প্রশ্ন কাননের মাথায় ঘুরতে থাকে । তাদের বাড়িতে টিভি ছিল না । সে টিভি দেখত গাঁয়ের মাতবর চাচার বাড়ি গিয়ে । শুধু বিশেষ কোনো নাটক, সিনেমা যখন চলত তখনই সে যেত । সেদিন কি মনে করে সে একটু আগেই হাজির হল । খবর চলছিল । সে তেমন মনোযোগ দেয়নি । হঠাৎ বিডিআর শব্দটি কানে আসতেই চমকে মনোযোগী হল সে । ঢাকার পিলখানা দরবার হলের ভেতরে বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে । অনেক আর্মি অফিসারকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বিডিআর জওয়ানরা । বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে শক্তহাতে । অনেক বিডিআর সদস্য পলাতক । পুলিশ হন্যে হয় জড়িতদের খুঁজছে । কাননের বুকের ভেতর থেকে উত্তেজনায় হৃদপিন্ড বের হয়ে আসতে চায় । প্রচন্ড ঘামতে থাকে সে । একছুটে বাড়িতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মাকে জিগ্যেস করে- বাজান কই, মা?
কাননের উত্তেজিত, ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মা খুব অবাক হয়ে তাকান । সাঁঝের টিমটিমে পিদিমের আলোয় ভারী অদ্ভুত দেখায় কাননের কচি, নিষ্পাপ মুখখানা । তিনি উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন- কি অইচে বাজান?
কিছু না! বাজান কই, কও শিগগির, বাজানের লগে কতা আচে!
তোর বাজান গঞ্জের থনে আহে নাও অহনতরি । কি অইচে আমারে ক!
কইলাম তো কিচু না । বাজান আইলে শুইনো ।
বলতে বলতেই বাইরে গলা খাঁকারির শব্দ শোনা যায় । বাবা এলেন । কানন বাবাকে বুঝিয়ে বলে । নিশ্চয়ই এই ঘটনার সাথে বিপ্লব ভাই জড়িত, নইলে কেন সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কেন সে গা ঢাকা দিয়ে আছে তাদের ঘরের কোণে! নিজের মতামত ব্যক্ত করে সে । সব শুনে বাবা ভয় পেয়ে যান খুব । খবরে যা দেখেছে কানন তাতে এ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, এদের যারা আশ্রয় দেবে তাদেরও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল । ভয়ে, উত্তেজনায় শরীর কাঁপতে থাকে তার ।
মা সব শোনেন । কেঁদে ফেলেন ভয়ে । বাবা বলেন- অরে চইলা যাইতে কও, অক্ষণ!
আহা! আগে তো পোলাডারে জিগাই কি অইচে, হ্যায় হাচাই অই কামে জড়িত আচিল কি না জাইন্যা লই । অহন তারে কেমনে আমি চইলা যাইতে কমু! আমার বোইনের পোলারে আমি কেমনে কমু বাজান, তুই চইলা যা, তুই থাকলে আমগোর বিপদ অইবো!-মার কণ্ঠ বুঁজে আসে । চোখ দিয়ে জল গড়ায় ।
খাড়াও, তোমারে কিচু কইতে অইবো না, আমিই কইতাচি!
বলে হনহন করে ঘরের দিকে হাঁটা দেন বাবা । পেছনে, কানন আর তার মা । বিপ্লব শুয়ে ছিল উপুড় হয়ে । ঝিমুচ্ছিল । বাবা গম্ভীর কণ্ঠে ডাকেন- বিপ্লব!
জ্বী, খালুজান!- ধড়মড় করে উঠে বসে বিপ্লব । চোখ লাল, চোখের নিচে অনিদ্রার ছাপ স্পষ্ট ।
তুমি অক্ষণ এইহান থন চইলা যাও! অক্ষণ যাও!
বিপ্লব ভয়ে ভয়ে বোঝার চেষ্টা করে পরিস্থিতি । বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় অবস্থা । তারপর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বলে- ক্যান খালুজান, কি অইচে?
তুমরা কি করচো ডাহায়?তুমরা বলে মেলা আর্মি মাইরা ফেলচো?মেলা কিচু লুটপাট করচো?খবরে যে কইতাচে?পুলিশ তুমাগোরে খুঁজতাচে? তুমি বাবা অক্ষণ চইলা যাও, নাইলে আমরা বিপদে পইড়া যামু!
এবার ফ্যাকাসে একটু হাসে বিপ্লব । তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে এসবের সাথে জড়িত নয়, এসবের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই । তাহলে কেন সে পালিয়ে আছে, প্রশ্নের উত্তরে জবাব দেয় আর্মির উপর এট্যাক হওয়ায় ভয়ংকর ক্ষেপে আছে তারা, বিডিআর এর যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরছে, তাই সে সাময়িক ছুটি নিয়েছে । পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবার সে চাকরিতে ফিরে যাবে । বাবা সন্তুষ্ট হন না তার উত্তরে, কাননেরও মনের মধ্যে কি একটা কাঁটা ফুটতে থাকে খচখচ । কিন্তু মা বিপ্লবের পক্ষ নেন । বাবার নিষেধ অমান্য করেই বিপ্লবকে আশ্রয় দেন তিনি । বিপ্লব থেকে যায় । কানন বড় একটা বিপ্লবের কাছ ঘেঁষে না আর । দূরে দূরে থাকে । মার সিদ্ধান্ত ভাল লাগেনি তার । কিন্তু মার কান্নার কাছে বাবা পরাজিত শেষতক । অগত্যা তারাও । সাতদিনের দিন সকালের দিকে হাজির হয় পুলিশ । ঘিরে ফেলে সারা বাড়ি । হাতকড়া পড়ে বিপ্লব আর তার বাবার হাতে । বিপ্লবকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে বাবাকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় অবশেষে ।
বেড়িবাঁধের নির্জনতায় বসে বাবার হাতকড়া পড়ানো চেহারা মনে করার চেষ্টা করে কানন । মনে করার চেষ্টা করে মার সেই জলে ভেজা মুখ, বাবাকে ছেড়ে দেয়ার নিষ্ফল অনুরোধ, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারির দৃশ্য । আশ্চর্য! এখন আর মার মুখটা তেমন স্পষ্ট ভাসে না মনে । তেমন কোনো কষ্টও জমে না বুকে । সে স্থির, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে নদীর নোংরা, কালো হয়ে আসা জলেভাসতে থাকা থির, শীতল চাঁদের দিকে । চাঁদটা কি বেহায়া, নির্লজ্জের মতো হাসে! কারও দুঃখ, যন্ত্রনা, বেদনায় কোনো বিকার নাই তার, নাই সামান্যও সহানুভূতি । আশেপাশে বেশ কবার নিশিকন্যার উপস্থিতি টের পায় সে । যে উদ্দেশ্যে তার এই নির্জনতায় আসা তা বিফলে যায় । বেশ কজন পাশে এসে বসে তাকে শিকারের চেষ্টা করে ফিরে যায় । অশালীন উক্তিও করে কেউ কেউ । সেদিকে কান দেয় না কানন । চেষ্টা করে জলে ডোবা চাঁদের দিকে মনোযোগ অক্ষুন্ন রাখতে । যেন চাঁদের গোলগাল ঐ ছায়ার মধ্যেই তার ভূত ভবিষ্যত একাকার হয়ে আছে ।
বাবাকে আটকে রাখেনি ।দুদিন পর ছেড়ে দেয় । গুমোট মেঘ কেটে যায় । আর তখনই ভুলটা করে বসে কানন । নিয়তি টেনে নেয় তাকে । বিপ্লব ভাইয়ের ব্যাগটা অযত্নে পড়েছিল ঘরের এককোণে । কি মনে করে ব্যাগটা খোলে সে । খুলেই চমকে ওঠে । ব্যাগের মধ্যে অনেক গহনা, সোনার । সেই সাথে খুব দামী একটা মোবাইল ফোনসেট । দেখেই বোঝা যায় । অফ করা সেটটা দেখে কৌতূহল হয় তার । বুকের মধ্যে খামচি দিয়ে জেগে ওঠে লোভ । খুব ইচ্ছে হয় সেটটা অন করে দেখে, সেটের ফাংশনগুলো জানার ইচ্ছেটা তীব্রভাবে খোঁচায় তাকে । সেট অন করে সে । অনেক ছবি, গান, ভিডিও আছে সেটটিতে । দেখে । অফ করে রাখে আবার । সকালে সেট অন করেছিল কানন । বিকেলেই পুলিশ ঘিরে ফেলে বাড়ি, পুনরায় । রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে সেটের অবস্থান বের করে ফেলেছে তারা ।
এবার বাবা নয় কাননের হাতে হাতকড়া পড়ে । লুট করা গহনা আর মোবাইল আত্মসাত করার গুরুতর অপরাধ তার বিরুদ্ধে । বাবা পুলিশ কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরেন । অনুরোধ করেন কাননের পরিবর্তে তাকে গ্রেপ্তার করা হোক । নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন তিনি । অগত্যা বাবাকে আবার ধরে নিয়ে যায় পুলিশ । বিচারে জেল হয়ে যায় বাবার । সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড । দ্রুতবিচার আদালত রায় দেয় । বাবার শোকে অল্পকদিন পরে মারা যান দাদী । বাবা দেখতে পাননি । ছোট ভাইটি আর সে মাকে আগলে রাখে । বোনের বিয়ে হয়ে যায় । ঢাকায় চলে যায় সে বরের সাথে ।
দূরে, নদীতে ছৈহীন নৌকা ভাসে । চাঁদের আলোয় দূর থেকে ঝাপসা দেখা যায় সেখানে ঘনিষ্ট যুগল মূর্তির অবয়ব । কানন ইচ্ছে করলেই পারে অমন কোনো নৌকায় কোনো এক নিশিকন্যাকে নিয়ে ঘনিষ্ট হতে । ইচ্ছে করে না । রুবির মুখটা ছলাৎ করে ওঠে বুকের ভেতর । রুবি! শেষ পর্যন্ত কিনা রুবিকে খুনের অপবাদ মাথায় নিয়ে লাপাত্তা হতে হলো তাকে! শুধু কি খুন! সাথে ধর্ষণ! এই অন্ধ সমাজকে সে কি করে বোঝাবে রুবিকে মোটেই ধর্ষনের প্রয়োজন ছিল না তার! রুবি তো তারই ছিল, শরীরে, মনে! তবে কেন সে ধর্ষণ করবে তাকে, কিংবা খুন! দুর্বলের কথা কেউ শোনে না কোনোদিন, তার কথাও শোনেনি কেউ ।
এমনি মাতাল করা জোছনা ছিল সেদিন । রুবি লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল তার সাথে । বাড়ির পাশের খোলা মাঠটিতে বেড়ে ওঠা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে অনেক রাত অব্দি গল্প করেছিল তারা, বিস্ময়মুগ্ধ চোখে দেখেছিল জোছনায় ডুবে যাওয়া পুরো গ্রাম, মাঠ আর নদীর সোনালী শরীর । রুবিকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরেছিল সে । ঘুম ভেঙ্গেছিল শোরগোল, চিৎকারে । রুবি খুন হয়েছে । খোলা মাঠের মধ্যে উদোম পড়ে আছে তার প্রাণহীন দেহ । সারা শরীরে রক্ত, জখম । সবুজ ফসলী জমিনে পড়ে ছিল রুবির রক্তভেজা শরীর । যেন এক টুকরো বাংলাদেশ, একটি পতাকা ।
বুকের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলে । তবু থির বসে থাকে কানন । কেন তাকে সন্দেহ করা হলো, কেন এক নম্বর আসামীর তালিকায় নাম উঠে গেল তার, সে আর জানা হলো না কোনোদিন । বাড়ি ফিরে যাওয়া রুবি কি করে চলে এল মাঠের খোলা বুকে, কেনই বা এল জানা হলো না তাও । বাবা জেলে । তার হয়ে লড়াই করার ছিল না কেউ । মা তাকে লুকিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় বোনের কাছে । হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন তার পরপরই ।কেমন দেখতে হয়েছিল মায়ের মৃত মুখটা কে জানে! এ বরং ভালই হয়েছে, তার কল্পনায় মা এখনও জীবিত । মায়ের মৃত মুখ তাকে দেখতে হয়নি, এ নিয়ে তেমন আফসোস তার ছিল না কখনও, এখনও নাই । বাবাকে নাকি পুলিশি প্রহরায় মায়ের জানাজায় অংশ নিতে দেয়া হয়েছিল । ছোট ভাইটি এখন কেমন আছে কে জানে । সাজা ভোগ শেষে বাবা ফিরে গিয়েছেন গাঁয়ে । বিয়ে করে বেশ নাকি সংসার সাজিয়ে নিয়েছেন । ভালো । জীবন কি আর থেমে থাকে! সেও কি থেমে আছে! রুবির জন্য কিছুই কি আটকে আছে তার! রুবির খুনি, ধর্ষক হিসেবে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে একটি জীবন! এই যা আফসোস!
ঘড়ি দেখে কানন । সাড়ে দশটা । একবার ভাবে ফিরে যাবে । শুধু শুধু বোন দুলাভাইয়ের মুখঝামটা ভাললাগে না । গেটেও দারোয়ান ঝামেলা করে খুব । কিন্তু চাঁদটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না । নদীর কালো জলে সোনালি চাঁদটা ঝিকমিকিয়ে ওঠে । জোছনার ছটায় অবশ করে তোলে কাননের সমস্ত শরীর, মন । মোহগ্রস্থ হয়ে সে ঘাট বেয়ে নেমে যায় । একটা খালি নৌকা ইশারায় ডাকে । নৌকা এগিয়ে এলে সে উঠে বসে । মাঝি অবাক হয়ে ইতিউতি তাকায় । কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে, - আপনে একা যাইবাইন?
হ্যাঁ, তুমি বাইতে থাকো ।
কথা বাড়ায় না মাঝি আর । ছপাৎ ছপাৎ দাঁড় টানার শব্দ ভাসে হাওয়ায় । নৌকার পাটাতনে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে কানন । মাথার উপর খোলা আকাশ, ভরা যৌবনা চাঁদ আর লক্ষ কোটি তারার দিকে তাকিয়ে বুকটা কেমন মুচড়ে ওঠে তার, কি যেন নাম না জানা বোধ বুকের মধ্যে অনবরত ঘাই মেরে চলে । একসময় ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পড়ে সে । চাঁদের রাশি রাশি জোছনা জল হয়ে ঝরে তার ঘুমন্ত শরীরে । তারাগুলো অবিরাম নেভে আর জ্বলে । ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে যায় । নৌকা ভেসে চলে নদীর মরে যাওয়া বুকে । মাঝি টের পায় যুবকটি ঘুমিয়েছে । ডাকে না সে । মাঝে মাঝে এমন উদ্ভ্রান্ত দু চার জন জুটে যায় তার নৌকায় । নিরুদ্বেগে সে বৈঠা বায় । ঘুমের মধ্যে কাননের মনে হয় নদী নয় কোনো এক নারীর বুকে ভেসে আছে সে । নারীটি আর কেউ নয়, রুবি, যাকে খুন এবং ধর্ষণের অপরাধে পলাতক আছে সে । কিন্তু নষ্ট এ সমাজ জানে না, রুবিকে ধর্ষণ করতে হয় না । তাকে ভালবাসলেই সে কাননের হয়ে যায় । কাননের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি লেগে থাকে । বিদ্রুপের, অগ্রাহ্যের, অস্বীকারের । চাঁদটা চারপাশে আগুনের চাকতি নিয়ে তখনও জেগে, একা ।

 
 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]