প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

আগরতলায় শরণার্থী নয় পর্যটক

 

--- অনুপ সাহা ---

 


আগরতলা স্টেশন থেকে ‘কুমারঘাট’-এর দূরত্ব ১০৮ কিলোমিটার। টিকেটের গায়েই লেখা আছে। ট্রেনটির যাত্রা আগরতলা, গন্তব্য আসাম-এর শিলচর। সকাল নয়টায় ছাড়ে গন্তব্যে পৌঁছে সন্ধ্যা সাতটায়। দশ ঘণ্টার ভ্রমণ। আমাদের গন্তব্য অতদূর নয়, ‘কুমারঘাট’ পর্যন্ত। আমাদের মানে আমি আর অনুজপ্রতিম বন্ধু জাবের, জাবের আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রামে শিল্পী এবং ফটোগ্রাফার হিসেবেই তার পরিচিতি। ক’দিন আগে চট্টগ্রামে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে বাংলাদেশের পথ-নির্দেশক ভাস্কর নভেরা আহমেদ-এর উপর জাবের-এর একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল। যাঁরা দেখেছেন প্রশংসাই করেছেন সবাই। একটি রুচিসম্মত ক্যাটালগও প্রকাশিত হয়েছিল।
অগাস্ট-এর ৩ তারিখ থেকে ৬ তারিখ জাবেরকে সাথে নিয়ে তিন দিনের জন্য আগরতলায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ত্রিপুরার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখা এবং আমার ৭১ সালের স্মৃতি পুনরাবিষ্কার করা ! অগাস্ট-এর ৪ তারিখ সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট (২৫ টাকা প্রতিটি, অগ্রিম টিকেটের ব্যবস্থা নেই) কেটে ট্রেনে উঠলাম, বসার জায়গাও মিললো, সবই দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। সকাল ৯টায় ছেড়ে ট্রেন বারটায় পৌঁছলো ‘কুমারঘাট’-এ। (’৭১ সালে আমরা যখন শরণার্থী হয়ে আগরতলায় গেছি তখন ত্রিপুরায় কোন ট্রেন ছিল না। শুনেছি পাঁচ/ছয় বছর আগে শুরু হয়েছে ট্রেনে যাতায়াতের সুবিধা) আমাদের গন্তব্য ঊনকোটি। কুমারঘাট থেকে অটো (সিএনজি) ছাড়ে কৈলাস হর-এর। আমরা দু’জন তাতেই চাপলাম। মাঝখানের সিটে তিন জনের বসার জায়গা। কিন্তু একটু যাবার পরই অটো চালক তিন জনের জায়গায় চাপাচাপি করে আরও একজনকে নিতে চায়। কৈলাস হর পর্যন্ত এক ঘণ্টার যাত্রা, চারজন হলে সত্যিই চাপাচাপি হবে। আমি চালককে ত্বরিৎ বললাম একজনের বাড়তি ভাড়া (৩০ টাকা) আমি দেব, সে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিল। পেছনে চারজন, চালকের দুই পাশে দুইজন, মাঝখানে আমরা তিনজন। মোট যাত্রী নয়জন। এদের নিয়ে অটো ছুটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তায় কৈলাস হর-এর উদ্দেশে। মাঝপথে চালককে ঊনকোটি পর্যন্ত যাবার প্রস্তাব দিলে সে সানন্দে গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, একই অটোতে কুমারঘাট ফিরে আসার রফাও করে ফেললাম। যাওয়া-আসা পাঁচশ টাকা। আমরাও খুশি, চালকও।
কুমারঘাট থেকে আগরতলার ফিরতি ট্রেন বিকেল পাঁচটায়। আমাদের ধারণা ছিল কৈলাস হর অথবা কাছের ধর্মনগরে রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরতে হবে। কিন্তু হিসেব করে দেখা গেল সেদিনের পাঁচটার ট্রেনে ফেরা সম্ভব। তাই এই ব্যবস্থা। কৈলাস হর-এ সব যাত্রী নেমে গেল। অটোতে আমরা দুইজন। আমি আর জাবের, আমাদের গন্তব্য ঊনকোটি। ঊনকোটি মানে এক কোটি থেকে এক কম। সেটির উল্লেখও আছে ঊনকোটি সম্পর্কে দর্শনার্থীদেরকে ধারণা দেবার জন্য সাইনবোর্ডে। আর একটি কথা লিখা আছে Ñ ‘এটি সম্ভবত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় স্থাপত্য শিল্প’। যাই হোক ফাঁকা অটোতে আমরা মাত্র দুজন, ভ্রমণে বেরুলে আমাদের বাড়তি ফুর্তির রসদ থাকেই! দু’জনে মিলে সেটির ভালোই সদ্ব্যবহার হোল। প্রচ- গরম পড়ছিলো সেদিন। গরমেরও খানিকটা লাঘব হোল। আমরা যখন ঊনকোটি পৌঁছি তখন দুপুর দেড়টা। হঠাৎ আমার বাংলাদেশের সেল ফোন সচল হয়ে উঠল। ঊনকোটি যাবার পরামর্শ দিয়েছেন শুক্লাদি (অধ্যাপক শুক্লা ইফতেখার, ইদানিং যিনি দলবল নিয়ে বেশ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন)। টেলিফোন সচল হওয়ার সাথে সাথে শুক্লাদিকেই ফোন করলামÑ ‘শুক্লাদি আমি অনুপ, ঊনকোটি থেকে, সাথে জাবের! শুক্লাদি ঊনকোটি থেকে আমার কণ্ঠ শুনে হতভম্ব(?), নাকি উল্লসিত ?
পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা উত্তর ত্রিপুরার রঘুনন্দন পাহাড়ের ঊনকোটিতে পাহাড়ের পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি। শুধু পাহাড়ের গায়েই নয়, অনেকটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় প্রস্তরখণ্ডকে বিভিন্ন মূর্তির রূপ দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা মুর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি মূর্তির একটি জটাধারী শিব অপরটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু কালভৈরবী মূর্তি। এছাড়া রয়েছে গণেশ, দুর্গা, বিষ্ণু, রাম, রাবণ, ব্রহ্মা, মহেশ্বর, নরসিংহ, হনুমান এবং শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। ঊনকোটির গণেশ কু- সংলগ্ন পাথরের দেয়ালে দক্ষ হাতে খোদাই করা আছে তিনটি গণেশ মুর্তি। এদের ডান পাশে চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি। ঊনকোটির ভাস্কর্যগুলো পায়ে হেঁটে দেখার জন্য রয়েছে ইট দিয়ে বাঁধানো সরু রাস্তা এবং সিঁড়ি।
ঐতিহাসিকদের মতে ঊনকোটির ভাস্কর্যগুলো তৈরি হয়েছে অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে। এই মুর্তিগুলো নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত আছে। সবচেয়ে লোকপ্রিয় কাহিনীটির মূল চরিত্র শিব। দেবাদিদেব শিব একবার দেবতাদের নিয়ে এই পথ দিয়ে বারানসী যাচ্ছিলেন। মহাদেবকে নিয়ে দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কোটি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার পর রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হল এই রঘুনন্দন পাহাড়ে। পথশ্রমে ক্লান্ত দেবতাগণ গভীর নিদ্রায় অচেতন হলেন। পরদিন কাক ডাকার আগেই সকলের বারাণসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা, কিন্তু মহাদেব ছাড়া অন্য কোন দেবতার নিদ্রাভঙ্গ হল না। শিব ঠাকুর বিরক্ত হয়ে একাই রওয়ানা দিলেন। গভীর নিদ্রায় সমাধিস্থ দেবতার কালনিদ্রা আর ভাঙলো না। অনন্তকালের জন্য তাঁরা পাথর হয়ে রয়ে গেলেন এই রঘুনন্দন পাহাড়ে। এই দেবতাদের সংখ্যা হল এক কম এক কোটি, অর্থাৎ ঊনকোটি। সেই থেকে রঘুনন্দন পাহাড় হয়ে গেল শৈবতীর্থ ঊনকোটি।
আগেই বলেছি, লেখা আছে সাইনবোর্ডে ‘সম্ভবত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মূর্তি’। ঘণ্টাখানেক দেখে, জাবেরের ক্যামেরা প্রতি মুহূর্তে সচল, এবার ফেরার পালা। আমাদের রিজার্ভ করা অটোটি অপেক্ষায় আছে। আমাদের নিয়ে ফিরবে কুমারঘাট। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনাই বলতে হবে, স্টার্ট দেবার সাথে সাথেই অটোটি বিকল হয়ে গেল। চালক অমূল্য বিব্রত, আমরাও। ভাগ্যতো রোদ-মেঘের মত খেলা করে, তার ওপর বর্ষাকাল। আমরা হঠাৎই আর একটি অটো পেয়ে গেলাম, কুমারঘাট পৌঁছে গেলাম বিকেল চারটায়। ট্রেন আসার এখনও এক ঘণ্টা দেরি। এদিকে পেটে তখন ইঁদুর-বেড়াল দৌড়োদৌড়ি করছে, বাড়তি ফুর্তির রসদের গুণাবলিও কার্যকর, হোটেলে ঢুকে সবজি, নলা মাছ, ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম দু’জনে। স্টেশনে পৌঁছে জানলাম ট্রেন আসবে সাড়ে পাঁচটায়। মানে আধ ঘন্টা লেইট।
সাড়ে পাঁচটায় ট্রেনে চেপে সন্ধ্যা আটটায় নামলাম যোগীন্দ্রনগর স্টেশনে, আগরতলার আগের স্টেশন। উদ্দেশ্য Ñ তাড়াতাড়ি পৌঁছোবো পিসির বাড়িতে। আমরা গতকাল দুপুর দুটায় আগরতলা পৌঁছে আমার পিসির বাড়িতেই উঠেছি। যাবার সময় শুক্লাদি বারবার বলে দিয়েছে, এমনকি ইফতেখার ভাইও (অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ খান, শুক্লাদির অর্ধাঙ্গ) ‘অবশ্যই আগরতলা স্টেশন দেখে আসবে’। আগরতলা স্টেশনতো সকালবেলা ঊনকোটি রওয়ানা হবার সময়ই দেখেছি। কী অদ্ভুত সুন্দর। আগরতলা রাজবাড়ির আদলে করা বিশাল স্টেশন, যেন আরেকটি রাজবাড়ি। মানুষ এভাবেই হয়তো ঐতিহ্যকে সম্মান দেখায়, ঐতিহ্য রক্ষা করে। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা চলেছি ঠিক উল্টো পথে।
প্রথম দিন গেলাম আমরা আগরতলা থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তরের ঊনকোটিতে। দ্বিতীয় দিনের প্রথম গন্তব্য আগরতলা থেকে ১১৫ কিলোমিটার দক্ষিণের অর্থাৎ বাংলাদেশের রামগড় বর্ডারের দিকের পথের পিলাক। সেখান থেকে উদয়পুর ফেরা এবং আমার ১৯৭১ সালের স্মৃতি হাতড়ানো বা পুনরাবিষ্কার। ৫ অগাস্ট শুক্রবার ভোর সাড়ে সাতটায় পিসির বাড়ি থেকে চা-বিস্কিট খেয়ে আমরা রিক্সা-অটোতে চেপে পৌঁছলাম বটতলা বাস স্ট্যান্ডে, সঙ্গে পিসতুত ভাই মনোজিৎ। এক ঘণ্টা পরের বিশ্রামগঞ্জে তার অফিস। আমাদের তিন ঘণ্টা পরের জোলাইবাড়ি, তারপর দুই কিলোমিটার দূরত্বের পিলাক। পথিমধ্যে ৫৫ কিলোমিটার দূরত্বের উদয়পুরও অতিক্রম করব আমরা। বাস রওয়ানা দিল সোয়া আটটায়। পাহাড়ি পথ। সকাল সোয়া নয়টায় মনোজিৎ নেমে পড়ল বিশ্রামগঞ্জ তার অফিসের উদ্দেশে। আমরা চললাম আরও দুই ঘণ্টা দূরের জোলাইবাড়ি। আঁকাবাঁকা পথে বাস এই ওপরে উঠে তো আবার নীচের দিকে নামে।
জোলাইবাড়ি পৌঁছি আমরা সকাল সোয়া এগারটায়। একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকে পুরির সাথে ডাল, একটি করে রসগোল্লা, এক কাপ করে চা খেয়ে উদর শান্ত করলাম আমি আর জাবের। জোলাইবাড়ি থেকে সাব্রুম (আমাদের দিকে রামগড়, যে পথে ’৭১ সালে বর্ডার অতিক্রম করেছি) ৩৫ কিলোমিটার। আমরা যাব ভেতরের রাস্তা দিয়ে ২ কিলোমিটার দূরের পিলাক-এ। একটি অটোর সাথে যাওয়া-আসা-অপেক্ষা মিলে দেড়শ রুপিতে রফা হোল। অটো রওয়ানা হল পিলাক-এর উদ্দেশে। পিলাকে অষ্টম এবং নবম শতাব্দীর বেশ কিছু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবি®কৃত হয়েছে। প্রাচীন বৌদ্ধ যুগেরও ইতিহাস জড়িয়ে আছে পিলাক-এর সঙ্গে। পরবর্তীকালে হিন্দু রাজাদের আমলে তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু মন্দির। কয়েক বছর আগে খনন করে আবিষ্কার করা হয় এসব বৌদ্ধ ও হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি। প্রায় দশ ফুট সূর্য দেবতার মূর্তি। এক চালা মূর্তির দুই পাশে আছে দুইটি সূর্যের বাহন, হনুমানের রিলিফ। আরও দুজন দেবীর মূর্তি একই চালায়। আরও অন্তত পাঁচটি ছোট আকারের মূর্তি আছে। সবগুলোই সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে। প্রতœতত্ত্ব বিভাগের বেশ ভালো একটি অফিসও নির্মাণ করা হয়েছে। তত্ত্বাবধান করেন শ্রী তপন দত্ত। তাঁকে কিউরেটর বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে হয়তো। তবে তিনিই একমাত্র কর্মকর্তা। তপন বাবু একটি হাস্যকর কথা বললেন Ñ বললেন তাঁর বয়স ৩০। অথচ দেখতে ষাট। আমার ঠিক উল্টো। অদূরে একটি গণেশ-এর মুর্তিও আছে। মন্দির করে পূজা-আচ্চাও করা হয়। তপন বাবু তাই বললেন। সব দেখিয়ে বুঝিয়ে তপন বাবু অনুরোধ করলেন মন্তব্য খাতায় কিছু লিখে যেতে। তালা খুলে পরিপাটি অফিস কক্ষে বসতেও দিলেন। আমি ব্যবস্থাপনায় তপন বাবুর প্রশংসা করে দু’লাইন লিখেও দিলাম। জাবেরের লিখা-টিখায় মন নেই। তার হাতের ক্যামেরা সর্বদাই সচল। যা দেখলাম তাঁর সবই খনন করে বের করা। তপন বাবু জানালেন এখানে আগে বাজার বসত। এবার অটোতে আধা কিলোমিটার দূরত্বের আরেকটি জায়গায় বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি। এটিও খনন করে আবিষ্কার করা হয়েছে। দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটির অনেক অনেক চিত্রকর্ম। জাবের প্রায় প্রতিটির ছবি তুলতে চায়। কারণ প্রতিটি টেরেকোটার ছবিই আলাদা আলাদা। একটির সাথে আরেকটির মিল নেই। এসব করে আমরা রিজার্ভ করা অটোতে জোলাইবাড়ি ফিরে এলাম। তখন বেলা একটা। আগেরটি নয়, আরেকটি মিষ্টি দোকানে ঢুকে সিঙ্গাড়া, নিমকি, রসগোল্লা, লালমোহন খেয়ে আমরা প্রস্তুত, গাড়ি পেলেই আমরা ছুটব ফিরতি পথের উদয়পুরে।
আমার ভিতরে যথেষ্ট উত্তেজনা। যুদ্ধকালের স্মৃতি আবিষ্কার করতে চলেছি। একটি কথা বলা হয়নি Ñ পিলাক যাবার পথে মিষ্টির দোকানে যখন চা খাচ্ছি তখন পাশে পরিষ্কার চট্টগ্রামের ভাষায় কথা শুনছি, তিনজন বসে গল্প করছেন। আলাপ হোল। বললাম আমরাও চট্টগ্রাম থেকে এসেছি, ত্রিপুরা বেড়াবো বলে। দেশের মানুষকে বাইরে দেখলে সত্যিই একটি অন্য অনুভূতি হয়! যা হোক এর মধ্যে একটি ভাড়ার জীপ এসে গেলো। আমরা উঠে পড়লাম মাঝখানের সিটে। আগেই একজন ছিলেন। আমরা দু’জন, মোট তিনজন। কিছুদূর এসে বেশ ধোপ-দুরস্ত ড্রাইভার আমাদের তিনজনের সাথে ঠাসাঠাসি করে আরেকজনকে বসাতে চান, পরে আমাদের কাছে পরাজয় মানেন। দুপুর তিনটায় আমার উত্তেজনার শহর উদয়পুরে পৌঁছি। একটি অটো নিয়ে আমার সেই জগন্নাথ দিঘীর পাড়ে সদ্যনির্মিত বেশ উন্নত মানের রয়াল হোটেলে উঠলাম। আজ রাত উদয়পুরেই থাকবো। একটু ফ্রেশ হয়ে দু’কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটি ব্যাটারির রিক্সায়।
তখন বেলা সাড়ে পাঁচটা। চলেছি আমার সেই ডাক বাংলো রোড-এ। সেই বাসাটি দেখবো একটু পরেই, যেটিতে একাত্তর সালের ছ’মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) আমরা ছিলাম। আমরা মানে আমাদের মা, আমরা চার ভাই-বোন, আমাদের ছোট কাকু আর আমাদের কাজের ছেলে প্রমোদ। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডাক বাংলো রোডে পৌঁছোই, সাথে জাবের। সে আমার উত্তেজনা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু কিছুই চেনা যায় না। ৪৫ বছর আগে যেখানে ছিল ধু ধু প্রান্তর এখন সেখানে বড় বড় বাড়ি, বিশাল বিশাল রাস্তা। কোনোভাবেই সেই বাসাটি আবিষ্কার করা যায় না। আমি তো নাছোড়বান্দা। একে, ওকে, কতজনকে জিজ্ঞেস করি কেউ হদিস দিতে পারেন না। আমি বাড়িওয়ালার নাম মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে তিনি ওভারশিয়ার ছিলেন। উদয়পুর ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। কিন্তু সে রকম কোন লোকের পরিবার এখন সেই এলাকায় থাকে না। প্রায় তিন ঘণ্টা খোঁজার পর আবিষ্কার করা যায় সেই বাসাটি। এখনও প্রায় আগের মতই আছে। বাড়ি মানে বিশাল বিলের এক কোণায় ওপরে টিনের চাল পাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়ে বাড়িওয়ালা থাকেন। বাংলাদেশের শরণার্থী এসেছে, বাড়ি ভাড়া হবে তাই একই রকম আরেকটি ঘর বানিয়েছেন। আমার বাবা কোনোভাবে খবর পেয়ে মাসে পঞ্চাশ টাকা হিসাবে ছ’মাসের তিনশ টাকা অগ্রিম দিয়ে বাসাটি বুক করলেন।
আমরা তখনও নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে, মাসির বাড়িতে। বাবা আমাদেরকে ডিমাপুর থেকে এনে উদয়পুর রেখে কোলকাতা চলে গেছেন মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করতে। বাবা তখন আতাউর রহমান খানের দল থেকে বেরিয়ে ভাষাসংগ্রামী অলি আহাদ সাহেবের সভাপতিত্বে গড়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় লীগ-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।
চট্টগ্রামের নেতা শফি সাহেব ও বখতিয়ার সাহেব প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশির ভাগ কাজ করেছেন ঘনিষ্ট বন্ধু এম. আর. সিদ্দিকীর সাথে। যাই হোক আমাদের শরণার্থী জীবন (প্রথমে আগরতলা তারপর ডিমাপুর) আবার শুরু হোল উদয়পুরের ডাক বাংলো রোডে। খুব জোর বার ফুট বাই ষোল ফুটের ঘরকে বেড়ার পার্টিশন দিয়ে দুই কামরা, রান্নাঘর আলাদা। এবার গিয়ে রান্নাঘরটি পেলাম না। দুই পরিবারের জন্য একটু দূরে একটি কাঁচা পায়খানা। একটি টিউব কল। যেটির বিশেষত্ব চব্বিশ ঘণ্টা জল পড়া। ক্লান্ত পথিকেরা দুপুর বেলার গরমে আমাদের বাসার গেইট ঠেলে কতজন যে তৃষ্ণা নিবারণ করতেন ! টিউবকল আর পায়খানাটি এখন আর নেই। পরিত্যক্ত বাড়ি। আমার রিক্সাওয়ালা বললো এই টিউবকলে সেও রিক্সা থামিয়ে অনেকবার তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। সেও বললো এই বাসাটিই সেই বাসা। পরে জানলাম আমাদের বাড়িওয়ালা জায়গাটি বিক্রী করেছেন। যিনি কিনেছেন তিনি জীর্ণ ঘরগুলো ভেঙে একই আদলে বর্তমানের ঘরগুলো করেছেন। একটি ঘর বাড়তি বানিয়েছেন। এখন তিনটি ঘর। তালাবদ্ধ। কারণ পরের বাড়িওয়ালা পুরো জায়গাটি উদয়পুর মিউনিসিপ্যালিটির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ কী একটা সাইনবোর্ডও লাগিয়েছে। শুধু এই বাড়িটিই কাঁচা ঘর। না হলে ৭১ সালের সেই বিশাল খোলা প্রান্তরে কত যে পাকা পাকা ঘর আর বড় বড় রাস্তা। চেনার উপায় নেই। তো ঘর আবিষ্কার করে আমি আরও উত্তেজিত। সাথে সাথে বাংলাদেশে আমার দাদা, অশোক সাহাকে ফোন করে দিলাম। বললামÑ ‘দাদা আমি এখন উদয়পুরে আমাদের সেই ঘরের সামনে’। অশোকদার কণ্ঠেও খানিকটা উত্তেজনা প্রকাশ পেল। অশোকদাকে বাড়িওয়ালার নাম জিজ্ঞেস করলাম। তারও নাম মনে নেই শুধু ওভারশিয়র এটুকু বলতে পারলো। জাবেরের ক্যামেরা চলছে আমার উত্তেজনা ধরে রাখবার জন্য। আমার কাছে মনে হোল Ñ আমি যেন কোন নতুন গ্রহণক্ষত্র আবিষ্কার করেছি।
উদয়পুরের কথা ভাবলে আমার একটি কথা মনেই হয় Ñ আমি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ অনুষ্ঠিতব্য এস. এস. সি পরীক্ষায় কলেজিয়েট স্কুল থেকে বসবো। বয়স ১৬। মুক্তিযুদ্ধে গেলাম না কেন? মুক্তিযুদ্ধের ব্যপারে আগ্রহেরতো কমতি ছিল না। শরণার্থী জীবনে উদয়পুরের চা স্টলে ভিতরে রেডিও বাইরে সাউন্ড বক্স। বাইরে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা মায় রাত সাড়ে দশটায় দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠের আকাশবাণীর সংবাদ প্রবাহ শুনে তারপর ঘরে ফেরা ঐ বয়সে ! তারপর মনে হয় Ñ ধরেই নিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে যাবার বয়স আমার তখনও হয়নি! শরীরের ঊনতাতো ছিলোই। আর মনে হয় Ñ আর দুই/তিন বছর যদি বেশি থাকতাম, তাহলে আমিও নিশ্চয়ই গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতাম। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ স্বাধীন করা কত গর্বের সেটি যেন বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে। উল্টো তাদের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যপারে মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করতেই দেখি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন না করলে দেখা যেত কম্পিটিটিভ পরীক্ষা ! শুধু প্রজন্ম কেন! স্বাধীন দেশ পেয়ে যারা শূন্য থেকে পূর্ণ হয়েছেন, কর্পোরেট কর্পোরেট আলাপ করছেন তাদেরও অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস নেই। উল্টো ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ভর করেছে তাদের অনেকের উপর। যাহোক আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম না। কিন্তু আমার দাদা অশোক সাহা (কমিউনিস্ট পার্টি), তখন চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র, বয়স ১৭। তারও সম্ভবত আমার মত অবস্থা Ñ বয়স হয়নি, আর শারীরিক ঊনতা। ছোট ভাই অসীমের কথা আর কী বলব! সে পড়ে কলেজিয়েট স্কুলেই, ক্লাস টেন-এ, বয়স ১৪। কিন্তু ঐ যে বলেছি আমার ছোট কাকা আছেন আমাদের সাথে। তিনিতো আমাদের চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়। তারই তখন যুদ্ধে যাবার সময়। অথচ তিনিও যান নি। তাঁকে দেখেছি সমবয়সী পাঁচ ছয়জন নিয়ে ছয়মাস তাস খেলতে। অথচ তিনি আ. স. ম. আবদুর রব এর বিশেষ পরিচিত।
আ. স. ম আবদুর রবকে কতবার দেখেছি উদয়পুরে আসছেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কাজে। আ. স. ম. রব পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলেও বাবার কাছে আসতেন। উদয়পুরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতেন চট্টগ্রামের এম. এন. এ. আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। আমার ছোট কাকাকে দেখতাম হারুন সাহেবের অনুপস্থিতিতে তাঁর বাসায় তাঁর ছোট ভাইসহ পাঁচছয়জন তাস পেটাচ্ছেন। উদয়পুরে আবদুল্লাহ আল হারুন ছাড়াও নোয়াখালীর আমাদের চৌমুহনী এলাকার এম. এন. এ. নুরুল হক, মাইজদীর এমপি কচি মিয়াসহ অনেক আওয়ামীলীগ নেতা, চৌমুহনীর অনেক ব্যবসায়ীও আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমপিদের জন্য আলাদা রেশন এর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অন্য কয়েকজন ব্যবসায়ী, ডাক্তারের সাথে আমার বাবারও রেশন-এর ব্যবস্থা হোল এমপিদের সাথে। সপ্তাহে সপ্তাহে রেশন তুলি আমি আর আমার ছোট কাকা। চাল, ডাল, চিনির সাথে নগদ ২৬ টাকা। মনে আছে, নভেম্বর মাসে ২৬ টাকার ২০ টাকা দিয়ে জুতা-মোজা কিনে ফেলেছিলাম। মা রাগ হয়েছিলেন। কারণ তখনতো সপ্তাহের রোজগার ঐ ২৬ টাকা আর বাবার পাকিস্তানী অচল টাকা ভাঙানো। ১০০ টাকায় ৪০ টাকা। ত্রিশ হাজার অচল টাকা। সেই টাকার পনের হাজার এখনও আমার কাছে রক্ষিত আছে। উদয়পুরের ডাকবাংলো রোডে আইএস অফিসের রফিক মিয়ার এখনও নুরুল হক মিয়া, কচি মিয়া, আবদুল্লাহ আল হারুনসহ অনেকের কথাই মনে আছে। কারণ তার বাড়ি ঐ জগন্নাথ দিঘীর পশ্চিম পাড়ে, যেই দিঘীর পাড়ে বিশেষ নেতারা থাকতেন, আর ছিলো এম.পিদের রেশন শপ।
তো সেদিন তিন ঘণ্টা রিক্সাওয়ালা যন্তর আলীকে নিয়ে উদয়পুরের মহাদেব দিঘী, জগন্নাথ দিঘী, অমর সাগার দেখে, রসদ নিয়ে জগন্নাথ দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের বিদ্যাসাগর রোডের রয়েল হোটেলে ফিরে এলাম। দু’জনে রসদের সদ্ব্যবহার করে ডিনার সেরে সারাদিনের শ্রান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম রাত এগারটায়। একাত্তরের স্মৃতি উদ্ধারের উত্তেজনায় খুব বেশিক্ষণ ঘুমানো গেলো না। ভোর তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর জীবনে প্রথম ভোর চারটায় øান করে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। হালকা একটু ঘুম হলো মনে হয়। আমার ভিতরটা আনচান করছে Ñ আবার একটু ডাক বাংলো রোডে সেই পুরোনো বাড়িটির সামনে যাব। সকাল সাড়ে সাতটায় হোটেল ছেড়ে জাবেরকে নিয়ে বেরুলাম। রিক্সাও পাওয়া গেল জগন্নাথ দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায়। এই রিক্সাওয়ালার নাম সমীর সাহা, জগন্নাথ দিঘীর পশ্চিম পাড়ে তার জন্ম। তাকে বললাম ডাক বাংলো রোডে সার্কিট হাউজের সামনে চলো। চেনে সে জায়গাটা। যাবার সময় মহাদেব দিঘী পড়ে হাতের বাঁ দিকে। রিক্সাওয়ালা তার রিক্সাটি নিয়ে দাঁড় করালো ডাক বাংলা রোডের ৭১ সালের আমার সেই পুরোনো বাড়িটির সামনে। রিক্সা থেকে নেমে আবারও কিছুক্ষণ দেখলাম, একাত্তরের পুরোনো স্মৃতি ভেসে আসে অনেক দূর থেকে। রিক্সাওয়ালাকে বললাম মহাদেব দিঘী, জগন্নাথ দিঘী, অমর সাগর দেখেছি গতকাল। এবার সবচেয়ে বড় ধনী সাগার যাও। কাছেই। অত বড় যে দিঘী হতে পারে দেখলেও বিশ্বাস হয় না। আরেকটি আছে ‘কল্যাণ সাগর’। পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে আর যাইনি। এবার চলেছি উদয়পুর রাজবাড়ীতে। শহরের মধ্যেই। ১৫০১ সালে মহারাজা ধন্যমানিক্য নির্মিত খুবই নামকরা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরেও যাইনি, একাত্তর গিয়েছিলাম। কথিত আছে Ñ মহারাজা ধন্যমানিক্য এই দেবী মূর্তি চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে উদয়পুর প্রতিষ্ঠা করেছেন। উদয়পুরে আরেকটি বিশিষ্ট মন্দিরের নাম ভুবনেশ্বরী মন্দির, রাজবাড়ী সংলগ্ন। এটি নির্মিত হয়েছে রাজা গোবিন্দ মানিক্যের রাজত্বকালে (১৬৬০-১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দ)। অতীতে এই মন্দিরে নরবলি হতো বলে কথিত আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজর্ষি উপন্যাস এবং বিসর্জন নাটক এই ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পটভূমিতে রচনা করেছেন।
এবার আমরা যাব নীরমহল দেখতে। উদয়পুর থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে মেলাঘর। একটি জিপের সামনের দু’সিটে বসে পড়লাম আমি আর জাবের। ড্রাইভারের সাথে কথাই হোল সামনে আর লোক নেবে না। রাস্তায় রাস্তায় যাত্রী উঠতে থাকলো। কিছুদূর গিয়ে এক সাথে ৮ যাত্রী। ড্রাইভারের উৎসাহ/আনন্দ দেখে কে! সাতজনকে পিছনে ঠাসানো গেল। একজন বাকী। এবার ড্রাইভার আমাদের জায়গা দিতে বলে। আমরা নড়ি চড়ি না। নাছোড়বান্দা ড্রাইভার তার দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে লোকটিকে আমাদের পাশেই বসালো। লোকটি অবশ্য লজ্জায় জড়োসড়ো। ড্রাইভারের দাবি সামনে তিনজনের সিট। আমরা যে ওঠার সময় বলেছি সামনে আমরা শুধু দুজন বসব এবং তাতে সে রাজী হয়েছে, সেটি বেমালুম চেপে যাচ্ছে। অবশ্য আমাদের প্রতিবাদের মুখে পরে চুপ করে যায় ড্রাইভার। একসাথে ৮ জন যাত্রীর লোভ কে সামলাতে পারে। এক ঘন্টায় আমরা মেলাঘর পৌঁছি। সেখানে দুই কিলোমিটার দূরত্বে বিশাল সরোবর। অটোতে যেতে ৫০ রুপি। আমরা ফিরতে অটো পাবো না, কারণ এ সময়ে পর্যটক একদম কম আসে। তাই আসা-যাওয়া ১০০ রুপি অপেক্ষা ১০০ মোট দুইশ রুপিতে অটো ঠিক করলাম।
সেখানে পৌঁছে অবাক হবার পালা Ñ বিশাল এক সরোবর। নাম রুদ্রসাগর, স্থানীয়রা বলে ‘রুদিজলা’। রুদ্রসাগরের ওপারে দেখা যাচ্ছে অসাধারণ সুন্দর নীরমহল। ১৯৩১ সালে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোরমানিক্যের উৎসাহে এই দৃষ্টিনন্দন জলমহলটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়, শেষ হয় আট বছরে। পরবর্তীকালে চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হয়ে নীরমহলের অনুপম সৌন্দর্য প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে এটির হারানো সৌন্দর্য ফিরে এসেছে। নিয়ম হলো প্রতিজনের ২৫ রুপি টিকিট। কিন্তু ১০ জনের কম হলে ইঞ্জিন বোট ছাড়বে না। আমরা যখন পৌঁছি তখন কোন পর্যটকই নেই। দু’জনে ২৫০ রুপি দিয়ে ১০ জনের টিকিট কেটে চাপলাম ইঞ্জিন বোটে। ছাড়বে এই সময় পাঁচ/ছয় জনের একটি পরিবার এলো। আমরা আমন্ত্রণ জানালাম কিন্তু তাঁরা এক পরিবারে একটি নৌকা নিয়ে যেতে আগ্রহী। আমরাও দেরি করলাম না, কারণ আমাদের আগরতলা ফিরবার তাড়া আছে। স্পীড বোট যতই ওপারের দিকে এগুচ্ছে ততই নীরমহলের সৌন্দর্য দৃশ্যমান হচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ওপাড়ে পৌঁছলাম।
সরোবর পাড়ে নীরমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম জাবেরের ক্যামেরার সচলতাতো ছিলই। বোটে এপাড়ে এসেছি। পেট চোঁ চোঁ করছে। ৭০ টাকায় দুটি ডাবের জল খেয়ে আপাতত পেট শান্ত হলো। অটো দাঁড়িয়ে আছে। তাতে চেপে বাস স্ট্যা-ে এসে চাপলাম সোনামুড়া-আগরতলা বাসে। পিসির বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর দেড়টা। তাড়াতাড়ি øান সেরে খেতে বসে যাই। সেদিনের মেন্যু Ñ নারকেল দিয়ে চিংড়ি ভাজা, কাতাল মাছের স্টীম, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছের লেজ-মাথা-কান, চট্টগ্রাম থেকে নেয়া রূপচাঁদা শুটকি আর মশুরের ডাল। উদর একেবারেই উপড়ে পড়ার জোগাড়। দুপুর বেলা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় পিসতুত ছোট ভাই মনোজিৎ-এর ভেসপার পিছনে আমরা দুজন। উদ্দেশ্য কিছু শপিং করা। দুর্গা পূজা উপলক্ষে সব বড় বড় দোকানে ৬০%-৭০% ডিসকাউন্ট। ডিসকাউন্টের লোভে কিছু শপিংও হয়ে গেল। রাতে পিসির ছোট ভাই পাশের বাড়ির রবি কাকুর বাড়িতে নেমন্তন্ন। ফিরতে দোকান থেকে রসদ কিনতে ভুল হয় না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রসদ গিলে রবি কাকুর বাড়িতে খেতে যাওয়া। আলু ভাজা করার নির্দেশনা আমারই ছিল চিকন চিকন আলু ভাজা, কাকরল ভাজা, কৈ মাছ, রুই মাছের কালিয়া, চিংড়ি মাছ, মশুর ডাল দিয়ে এ বেলাও ভুরি-ভোজ। একই দিনে দুবেলা ভুরিভোজ এ কয়দিনে হয়নি।
পিসির বাড়িতে এসে রাতের ঘুম। পরদিন আখাউড়া থেকে চট্টগ্রামে আমাদের ট্রেন সাড়ে তিনটায়। অনেকটা সময় হাতে। তাই সকাল ৮টায় একটি অটো রিজার্ভ করে আগরতলা শহরের ঘুরে ঘুরে Ñ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হেরিটেজ পার্ক (সকালে দর্শনার্থী ঢোকার অনুমতি নেই, শুধুই মাসিক টিকিট কাটা প্রাতভ্রমণকারী। বিদেশি দেখে দশ টাকার টিকেট দিয়ে আমাদের দু’জনকে ঢুকতে দিল।) বিধানসভা ভবন, রাজভবন, নামকরা এম.বি.বি. কলেজ দেখে বাড়ি ফিরি। এর আগে ৩ আগস্ট বিকেল বেলা দেখেছি বাজার বাড়ি (বর্তমানে ত্রিপুরার মিউজিয়াম), জগন্নাথ বাড়ি, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির এবং শেষে এক ঘন্টা রিক্সায় আগরতলা শহর দেখা এবং রসদ কেনা।
দুপুর বারটায় পিসির বাড়িতে খেয়ে সাড়ে বারটায় বেরিয়ে দেড়টায় আমরা আখাউড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। সাড়ে তিনটার পাহাড়িকা এক্সপ্রেস চারটায় এলো। আমরা উঠে প্রথম শ্রেণীতে টিকেট কাটা আমাদের সিটে বসতে গিয়ে দেখি রেলওয়ের এক হর্তাকর্তা আমাদের সিটে বেশ আয়েশ করে বসেছেন। তার আর্দালিরা কক্ষটিকে হর্তকর্তার ডাইনিং রুমে পরিণত করেছেন। তাঁকে উঠতে বললে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন। তর্কাতর্কিই লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত লোকটিকে ‘ফালতু লোক’ বলে গালিও দিতে হলো। শেষমেশ তিনি কামরা ছেড়ে বেরুলেন। না বেরিয়ে উপায় কী! রাত আটটায় আমি আর জাবের চট্টগ্রাম স্টেশনে নামলাম। এই পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনেই আমরা ৩ আগস্ট বুধবার সকাল পৌঁনে নয়টায় চট্টগ্রাম থেকে আগরতলার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম। ত্রিপুরায় তিন দিনের বেড়াবার সফর বলা যায়। এবার ৭১-এর ২৪ এপ্রিলের শরণার্থী হিসেবে নয় পর্যটকের বেশে।
 

 
 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]