প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

ময়লা নিয়ে ভাবনা- আর না, আর না!

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

লক্ষী বউ তুমি কী করছো? আহ্হা আমি ভাবছি। কী ভাবো? এইতো অনেক কিছু। অনেক কিছু মানে কী? দূর ছাই, ময়লা আর ময়লা। কেন এসব ময়লা-নোংড়া নিয়ে ভাবছো? ভাবতে হচ্ছে যে আমার! ভাবতে থাক এসব নিয়ে। - "কাকু", আমার মনে হয় ময়লা পরিষ্কার নিয়ে ভাবছে! ভাবনাগুলো বড্ড বদহজমের! ভাবনা কি আর সহজপাচ্য হয়? সখী, ভাবনা কাহারে বলে... সখী, যাতনা কাহারে বলে। সখী, ময়লা কারে কয়... সে কি কেবলই যাতনাময়। মানবী মস্তিষ্ক তো তাই এতো ভাবনা- কি দিয়ে এক্কেবারে ময়লা-টয়লা সাফ করা যায়? আমি বলি কি- ময়লা নিয়ে ভাবনা- আর না, আর না!

গৃহিণী, চল এবার ভাবনাকে নির্ভাবনাময় করে তুলি। প্রথমেই একটু জেনে নিই ময়লা কি। কাপড়ের ময়লা বলতে বুঝি জৈব (organic) এবং অজৈব (inorganic) পদার্থের একটি মিশ্রণ। দেখ, আমাদের দেহ (প্রোটিন, চর্বি), আমাদের কাপড় (সেলুলোজ), রান্নার তেল (ফ্যাট এবং ফ্যাটি অ্যাসিড) এসবই তো জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরী। এ মিশ্রিত উপাদানগুলি শরীর হতে নিষ্কৃত বর্জ্যপদার্থ জৈব ময়লা হিসেবে কাপড়ে আটকে থাকে। অন্যদিকে ধূলা-বালি এসব অজৈব ময়লা তো আপনার দামী কাপড়ে লেগেই থাকে।

ভাবনাহীন করতে ময়লার দুশমন 'ডিটারজেন্ট' (detergent/sufactant) এর কথাই বয়ান করছি। ডিটারজেন্ট হল লম্বা কার্বন শিকল যুক্ত একটি অণু। মনে রাখা ভাল, ডিটারজেন্ট অণুর গঠন সাবানের অণুর থেকে ভিন্ন। যা খর পানিতেও সমানভাবে কার্যকর। ডিটারজেন্ট এবং সাবান দুটির কাজ এক হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাবান সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি, আর ডিটারজেন্ট কৃত্রিম উপাদান (synthetic) থেকে তৈরি।

দীর্ঘ শিকল বিশিষ্ট বিভিন্ন এলকোহল (যেমন-লরাইল এলকোহল, C12H25OH) এর সাথে সালফিউরিক এসিড (H2SO4) যোগ করলে করেসপন্ডিং এলকোহল হাইড্রোজেন সালফেট উৎপন্ন হয়। লরাইল হাইড্রোজেন সালফেটকে (C12H25OSO3) কস্টিকসোডা (NaOH) দ্রবণের মধ্য দিয়ে চালনা করলে সোডিয়াম লরাইল সালফোনেট (C12H25OSO3Na) নামক ডিটারজেন্ট উৎপন্ন হয়। সকল ডিটারজেন্ট কিন্তু একই সংযুক্তিতে থাকে না। প্রচলিত দুটি কৃত্রিম বা সিনথেটিক ডিটারজেন্ট হল- (১) দীর্ঘ শিকল বিশিষ্ট সোডিয়াম অ্যালকিল সালফেট [CH3-(CH2)10-CH2- SO-4Na+] এবং (২) দীর্ঘ শিকল বিশিষ্ট সোডিয়াম অ্যালকিল বেনজিন সালফোনেট [CH3-(CH2)11-C6H4-SO-3Na+]। বর্তমানে দ্বিতীয় ডিটারজেন্টটি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। উৎপন্ন ডিটারজেন্টের মধ্যে প্রায় ২০-৪০% সক্রিয় পদার্থ থাকে বাকী বিল্ডার (builders), ফিলার (filler) ও রং (dye) ইত্যাদি মেশানো হয়। ডিটারজেন্টকে পাউডার, দানা, তরল অথবা বার হিসেবে বাজারজাত করা হয়।

ডিটারজেন্টের সঙ্গে সোডিয়াম ট্রাইপলিফসফেট, টেট্রাসোডিয়াম পাইরোফসফেট বা সোডিয়াম কার্বনেট মিশিয়ে একে ক্ষারীয় করলে এর ময়লা পরিষ্কারের ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এছাড়া, সোডিয়াম সালফেট ও সোডিয়াম সিলিকেট মেশানো হয় ডিটারজেন্টকে শুষ্ক রাখার জন্য। ডিটারজেন্টের কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ উপাদানটি জলের মধ্যে ময়লার অণুগুলিকে প্রলম্বিত রাখে, ফলে অধিক পরিমাণে ময়লা পরিষ্কার করে। ব্লিচিং পদার্থ হিসাবে সোডিয়াম পারবোরেট (NaBO3) মেশালে শুভ্রতা বাড়ে।

সারফেস অ্যাকটিভ এজেন্ট (surface active agent) থেকে সার্ফেকট্যান্ট নামের উৎপত্তি হয়েছে। ডিটারজেন্ট বা সার্ফেকট্যান্ট জলের নিজের অণুর প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দিতে পারে। জলে সার্ফেকট্যান্ট গুললে জলের অণুর কমে আসা আকর্ষণের জন্য জলের পৃষ্ঠটান (surface tension) কমে যায়। ফলে ময়লা আর জামাকাপড়কে আটকে ধরে রাখতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, জলের এই পরিবর্তন আনার জন্য কতটা ডিটারজেন্ট প্রয়োজন? এক বালতি জলে এক চামচ? এক মুঠো? নাকি এক কিলোগ্রাম? ডিটারজেন্টের আণবিক গঠনে একটি মাথা এবং একটি লেজ আছে। সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic) অর্থাৎ জলের অণুগুলির প্রতি আকর্ষণ প্রবল। আর লেজটা হাইড্রোফোবিক (hydrophobic) অর্থাৎ জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। ডিটারজেন্টের কার্যক্ষমতা জলে তাদের ঘনত্বের (concentration) উপর অনেকটা নির্ভরশীল। সাবানের অণুর ঘনত্ব একটা বিশেষ ঘনত্বের (একে critical micelle concentration বা CMC বলা হয়) নিচে হলে, অণুগুলির মধ্যে মিথোষ্ক্রিয়া বা interaction না হওয়ায় অণুগুলি জলে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ঘনত্ব CMC-র উপরে পৌঁছলেই দ্রুত এরা নিজেদেরকে গোলকাকারে মাইসেল (micelle) সাজিয়ে নেয়। এই মাইসেল এমন ভাবে তৈরী হয়, যাতে হাইড্রোফিলিক মাথাটা (SO3-Na+) বাইরের দিকে অর্থাৎ জলের সংস্পর্শে থাকে। আর হাইড্রোফোবিক লেজটি [R-(CH2)n-] ভেতরের দিকে অর্থাৎ ময়লার দিকে আকর্ষণ করে থাকে। যেমন- 'কান টানলে মাথা আসে' তেমনি জল সহজেই এই মাথায় হ্যাঁচকা 'টান মেরে' লেজে আটকে থাকা ময়লাকে কাপড় থেকে তুলে ফেলে। এরপর এ ময়লাগুলো জল ধুয়ে ফেললেই কাপড় এক্কেবারে সাফ!

সোজা-সাপ্টা কথায় বলা যায়- ময়লা কাপড়কে যখন ডিটারজেন্টসহ পানিতে ভেজানো হয় তখন হাইড্রোফোবিক অংশ কাপড়ের ময়লার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এতে দ্রবীভূত হয়। পক্ষান্তরে, হাইড্রোফিলিক অংশ চতুষ্পার্শ্বে পানির স্তরে প্রসারিত হয়। এ অবস্থায় কাপড়কে ঘষা দিলে ময়লা সম্পূর্ণরূপে হাইড্রোফিলিক অংশ দ্বারা আবৃত হয়ে জলে ধৌত হয়ে যায়। ফলে কাপড় পরিষ্কার হয়।

এ ডিটারজেন্ট-ই ভাগ্য খুলে দিয়েছে এক 'নুন আন্তে পান্তা ফুরায়'- উত্তর গুজরাটের এক কৃষক পরিবারের। রসায়ন বিভাগ থেকে ২১ বছর বয়সে বিএসসি পাশ করে একজন নতুন কিছু করার চিন্তা থেকেই নিজের বাড়ির পেছনে শুরু করেন কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট তৈরি। নিজের আদরের মেয়ে নিরুপমা'র নামে বাজারে ছেড়ে দেন- 'নিরমা ডিটারজেন্ট পাউডার' যা আজ আমাদের কম-বেশী সবার কাছেই পরিচিত। আপনিও হয়ে যেতে পারেন কোটিপতি ডিটারজেন্ট-এর গুণে!

-বেশ, জলে ছেড়ে দিলেই সাফ! কি গো গিন্নী এবার ভাবনা দূর হল? অহুঁ ময়লা নিয়ে ভাবনা আর নয়, চল আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে বলি- "সখী, ভালোবাসা কারে কয়"!!

 

______________________

লেখক: প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়   

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]