পায়রা বিবি
-যুথিকা
বড়ুয়া-
বছরখানেক আগে এক জলসায়
গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল, ‘ভ্যালেনটাইনস্ ডে’। ঘরোয়া পরিবেশ হলেও পার্টি হলের
ঝুলন্ত সুদর্শন সোনালী ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি আলোর কণায় বেশ রোমান্টিক লাগছিলো।
দেখলাম, তখনও থোকায় থোকায় লালরঙের হার্টসেফের বেলুন আর সুবর্ণ আলোর মালায়
চলছে ডেকোরেশনের পর্ব। তার ঘন্টাখানেক পরই শুরু হয় চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার
ছড়িয়ে, আতরের গন্ধ উড়িয়ে, হাসির ফোয়ারা তুলে বাহুবেষ্টিত যুগলবন্দী
কপোত-কপোতীর পালা করে আগমন-কথোপকথনের গুঞ্জরণ; হাসির কলতান।
ধীরে ধীরে বেশ
আনন্দোৎচ্ছল সমারোহে ছেয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক মনোরম রোমাঞ্চকর পরিবেশ। বেশ
উপভোগ্যই বটে! ক্ষীণ শব্দে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজজে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের
অপূর্ব মূর্ছনা। অন্যদিকে আগন্তুক অথিতিরাও উন্মুক্ত চিত্তে কুশল বিনিময়ে
মশগুল।পাশেই বিরাটাকারের একটা বিস্তৃত টেবিল জুড়ে সাজানো রয়েছে রকমারি
আহারের চমৎকার বন্দোবস্ত। তার সাথে হুইস্কি, বীয়ার, ব্র্যাণ্ডি এবং সফ্ট
ড্রিংক্সও আছে।
হঠাৎ দেখি, এক উর্বশী যুবতী রমণী ধুমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই তার ডাগর
চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে কাকে যেনো খুঁজজে। তার চেহারা আর চটকদারী
বেশভূষায় মনে হয়েছিলো যেন এক স্বপ্নপরী স্প্যানিশ কন্যা। তারপরই দেখি,
চোখেমুখের বিচিত্র ইশারায় কাকে যেনো কী একটা সংকেত প্রেরণ করতে করতে গ্লাসে
বিয়ার ঢালছে। ঢেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফিল্মী হিরোইনদের মতো প্রাণবন্ত
চঞ্চলতায় রহস্যাবৃত চোখের চাউনি মেলে ইউরোপীয় ষ্টাইলে ছোট্ট-ছোট্ট চুমুকে
পান করতে করতে একটা সোফার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াতেই দেখি, ভীড়ের
মধ্যে থেকে পাগড়ি পরিহিত লম্বাটে সুঠাম ও সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যুবক এসে
ওর গা-ঘেষে দাঁড়ায়। সেও উচ্ছ্বাসে একেবারে উতল। ৫৫৫ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে
পুরুষালি ভঙ্গিতে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে তার মুগ্ধচোখের দৃষ্টি
মেলে আস্বাদন করতে থাকে, হৃদয়াকর্ষক সৌন্দর্যের পারিজাত ঐ উর্বশী রমণীর
বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রঙ আর রূপ।
ইতিমধ্যে হারানো দিনের একটি গান দিয়ে শুরু হয় জলনার প্রথম পর্ব। তার পরই
সমগ্র উপস্থিত মন্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই উর্বশী রমণীর মনোমুগ্ধকর একটি
নৃত্য পরিবেশনায়। সেটি ছিল একটি বাংলা ছায়াছবির গান। ‘গা ছমছম কি হয় কি হয়…থমথমে
রাত যতই বাড়ে…ম্যায় হুঁ পায়রা পায়রা বিবি…পায়রা বিবি হাম’।
ক্ষীণ আবছা অন্ধকারে সুবর্ণ ঝিকিমিকি আলোর কণায় মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল,
নৃত্যটি যেনো রঙ্গিন পর্দায় প্রদর্শীত হচ্ছে। উৎসুক্য হয়ে সমগ্র উপস্থিত
মন্ডলী সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে একেবারে উন্মত্ত চিত্তে নৃত্যটি উপভোগ করতে থাকে।
কিন্তু জোরালো করতালি সহ একরাশ প্রশংসা কুড়িয়ে মন্ত্রের মতো হঠাৎ চোখের পলকে
দুজনে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো, সেই রাতে ওদের আর দর্শণই পাওয়া যায়নি।
তার মাস ছয়েক পরের ঘটনা। সেদিন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। চারদিক নিঝুম,
নিস্তব্ধ। বৃষ্টিও পড়ছিল গুরি গুরি। তাই দৌঁড়ে যাচ্ছিলাম বাস ধরবো বলে।
ইতিপূর্বে ট্রাফিক সিগ্ল্যালের গ্রীণ লাইটটা জ্বলে উঠতেই বাসটি দ্রুত পাস
করে গেল। আর তক্ষুণি মহিলা কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই আমি থমকে দাঁড়াই। -‘আও
ব্যাহেন আও, ইধার আও!’
পিছন ফিরে দেখি, একজন অচেনা মহিলা। আশেপাশে কেউ নেই। কাঁচের তৈরী
বাসষ্টপেজের ছোট্ট শেল্টারে বসে আছে। বৃষ্টির ছাপটায় স্পষ্ট দেখতে
পাচ্ছিলাম না। -কে এই মহিলা? খানিকটা বিস্ময় নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। চোখে
চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে অস্ফূট একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে মহিলাটি মৃদু স্বরে
বলে ওঠে,-‘হায়, হাউ আর ইউ? পহেচানা? ম্যায় সুলোচনা!পায়রা বিবিকো এয়াদ
হ্যায়?’
পায়রা বিবি? এ আবার কেমন নাম! এ নামেতো কাউকে চিনিনা! কে এই মহিলা? ভাবতে
ভাবতে ওর আপাদমস্তক নজর বুলাতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই বিস্ময়ে,-এ কি, এ তো
সেই উর্বশী রমণী। এ কি হাল হয়েছে ওর! জরাজীর্ণের মতো নিথর, নিস্তেজ শরীর।
চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। ওকে কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। কোনো
বিকার নেই। উচ্ছাস নেই। সাজ-সজ্জার বালাই নেই। কেশ-বিন্যাশ এলোমেলো।
প্রসাধনের অবস্থাও তদ্রুপ। পরনের পোশাকটি দামী হলেও মলিনতার ছাপ প্রকট।
ইতিমধ্যে নাকের ডগা দিয়ে তীব্রবেগে চলে গেলো আরো দু’টো বাস। অথচ বাড়ি ফেরার
কোনো তাগিদই বোধ করছে না সুলোচনা। মনে হচ্ছিল, প্রবল ঝড়ের মুখে উড়ে আসা
মুমূর্ষ্যূ পাখীর মতো নির্জনে চুপটি করে বসে আছে। সংসারে কেউ নেই ওর। বাড়ি
ফেরার কোনো তাড়া নেই। আর সময় মতো না ফিরলে বাড়িতে চিন্তা ভাবনা করবে,
সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! ব্যাপারটা কী! কিছু ঘটেনি তো!
হ্যাঁ, ঠিক তাই। অনুমান মিথ্যে নয়। ওর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়তেই আমায় জড়িয়ে ধরে
সুলোচনা হু হু করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে সাশ্রুনয়নে উন্মোচিত হতে
লাগলো ওর প্রতারিত জীবনের করুণ কাহিনী।
আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে নব-পরিণীতা সুলোচনা ইমিগ্র্যাণ্ট হয়ে কানাডায়
পাড়ি দিয়েছিল প্রিয়তম স্বামী সন্দীপের হাত ধরে। জাতিতে ওরা দুজনেই মারাঠী।
কোলকাতায় একই কলেজে পড়তো দু'জনে। সন্দীপের পিতা ছিলেন একজন প্রভাবশালী
ব্যক্তি। তৎকালীন কোলকাতা শহরের পলিটিক্যাল পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা।
উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশধর। তারই সুপুত্র সন্দীপ
যোগলেকর। কিন্তু সন্দীপ ছিল পিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনীতির অঙ্গন থেকে
একেবারে আলাদা। ওরওওর ও পড়াশোনার পাশাপাশি যন্ত্র সঙ্গীতে খুব পারর্দশী
ছিল। গীটার প্লে করতো। ষ্টেজে পারফর্ম করতো। যেটা ওর পিতার একেবারেই অমত
ছিল। আর সে কারণেই পিতার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ইকোনমিক্সে মাষ্টার্স
করে মাতা-পিতার অজ্ঞাতসারে সুলোচনার সাথে কোর্ট ম্যারেজ করে পাড়ি জমায়
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে। তখন কচি বয়স সুলোচনার। আবেগে, উচ্ছাসে একেবারে
উতলা। আকস্মিক নিজস্ব গণ্ডি ছেড়ে বাইরের রঙ্গীন পৃথিবীতে পর্দাপণ করে
ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল আকাশের চাঁদটাই বুঝি পেয়ে গিয়েছে ওর হাতে। আর
নাগাল পায় কে! খুশির পাল তুলে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো জীবন জোয়ারে ভাসতে থাকে।
বিদেশী পর্যটকের মতো প্রচণ্ড বিস্ময় ও ঔৎসুক্য নিয়ে শহরের নানাবিধ মনোহরা
দর্শনীয় স্থানগুলি একে একে ঘুরে দেখতে লাগলো। যখন রামধনুর মতো ওর হ্রদয়
আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল চিরঞ্জিত সিং।
ততোদিনে সন্দীপের কাঙ্ক্ষিত বাসনাগুলিও একে একে সব পূরণ হতে লাগলো।
মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চপদস্থ চাকুরী, দেশীয় ষ্টাইলে আলিশান বাড়ি, গাড়ি,
বিলাসবহুল আসবাবপত্র, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য, দামী শাড়ি-গহনা, সব পরিপূর্ণ।
যখন স্বর্গসুখ ছিল সুলোচনার হাতের মুঠোয়।
ইতিমধ্যে সুযোগ্য পুত্র সন্দীপের আশাতীত সাফল্যের সুসংবাদে মনের ক্ষোভ,
অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ সব অপসারিত করে ওর মাতা-পিতা ভিজিট করতে চলে আসেন
কানাডায়। যা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি।
কিন্তু বিধিই বাম! খণ্ডাবে কে! যোগলেকর পরিবারে অপ্রত্যাশিত এতো
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ মঞ্জুর হলো না বিধাতার। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো
একদিন হঠাৎ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সন্দীপের অপমৃত্যুতে নিভে গেল
সুলোচনার ভালোবাসার প্রদীপ। ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে গেল ওর সোনার সংসার,
ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ। অচিরেই জীবনে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। জীবন-নদীর খেয়া ওকে
নিয়ে চলে অনিশ্চিত মোহনার দিকে। যেখানে কূল নেই, কিনারা নেই, নেই বেঁচে
থাকার কোনো উপাদান। যা কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি সুলোচনা, তাই ঘটে গেলো ওর
জীবনে।
সদ্য স্বামী হারানোর শোকে কাতর মুহ্যমান সুলোচনার উপরে অমানবিকভাবে শুরু হয়
শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, মিথ্যে
কলঙ্ক-অপবাদ লেপন। নিষ্ঠুর নির্দয়ের মতো তাঁরা প্রতিনিয়ত শুধু বলতেন,
‘ডাইনি, পোড়ামুখী, রাক্ষসী, কুলাঙ্গার! দূর হ এখান থেকে। তোর কোনো অধিকার
নেই এখানে থাকবার!’
অথচ ওনারা একবারও ভেবে দেখলেন না যে, অকাল বৈধব্যে তারুণ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে
উনত্রিশ বছরের যুবতী মহিলা একা কোথায় যাবে! কোথায় থাকবে! কিভাবে জীবনযাপন
করবে! দূরদেশে যার কেউ নেই, কোন্ সাহারায় সে বেঁচে থাকবে! আর তখনি
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে চিরঞ্জিত সিং। যাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে ও
বিশ্বাস করে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিল সুলোচনা। আর কৌশলে সুযোগের সদ্ব্যবহার
করে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সুলোচনার অন্ধকার জীবনে আলোর পথ দেখাতে চিরঞ্জিতই
ভ্যাঙ্কুভার থেকে ওকে নিয়ে এসেছিল টরণ্টো শহরে। যদিও অন্তরাত্মা সাড়া
দিচ্ছিলো না, তবে বিবেকের দংশনের বিপরীতে নিজেকে শান্তনা দিয়ে সেদিন
সুলোচনা মনে-মনে ভেবেছিল, দিনকাল বদলে গিয়েছে-বদলে গিয়েছে মানুষের রুচি,
ধ্যান-ধারণা। সতীদাহ প্রথাও উচ্ছেদ করে দিয়েছেন রাজা রামমোহন রায়। তারুণ্যে
বিধবার পূণর্বিবাহের রেওয়াজও বহুকাল থেকেই প্রচলিত। পাপ-পূণ্যের দোহাই
দিয়ে, নিজের সাধ-আহ্লাদ, কামনা-বাসনাগুলিকে বিসর্জন দেবার চেয়ে জীবনকে নতুন
রঙে নতুন ঢঙ্গে সাজিয়ে তোলাই ঢের ভালো!
কিন্তু নারীর মন বড়ই নাদান। মতলবী পুরুষমানুষের ভণ্ডামী, সহসাই নারীর মনের
আয়নায় ধরা পড়ে না। উপরন্তু, সে আবেগের বশীভূত হয়ে, দৃঢ় বিশ্বাসে ভর করে
ভালো-মন্দ যাচাই না করেই অন্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে।
যার কূল নেই, কিনারা নেই, নেই গন্তব্যর কোনো ঠিকানা।
সুলোচনা মনস্থির করে, টরোণ্টো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শুরু করবে।
স্বাবলম্বী হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। শুনে খুব খুশি হয় চিরঞ্জিত।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে কী মতলব আঁটছিলো, তা ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি
সুলোচনা।
প্রতিদিন আর্লি মর্নিং-এ দুজনে একসাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। আবার বিকেলের
দিকে একসাথেই বাড়ি ফিরতো।
সেদিন যথারীতি সুলোচনা বাড়ি ফিরে এসে দ্যাখে, ঘরের দরজাটা আলতোভাবে খোলা।
ভাবল, চিরঞ্জিত এসে পড়েছে। এখুনিই চা-নাস্তা তৈরী করতে হবে। এইভেবে দ্রুত
ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাথায় যেন ওর বজ্রাঘাত পড়ে।-এ কী!ঘর-দুয়োরের এ অবস্থা
কেন? ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো! চারদিকে ছড়ানো। কোথায় চিরঞ্জিত? ও তো
আসেনি! তবে কি বাইরের কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকে ছিলো? সর্বণাশ!
বিচলিত হয়ে পড়ে সুলোচনা। দ্রুত এ-ঘর ও-ঘর নজর বুলিয়ে দ্যাখে, চিরঞ্জিতের
পরনের জামা-কাপড়, কোট-টাই, দামী স্যুট কিছু নেই। লেদারের বড় একটা স্যুটকেস
ছিল, সেটাও নেই। তার মধ্যেই সযত্নে রাখা ছিলো সুলোচনার কিছু গহনা, টাকা
পয়সা, ল্যাডিং পেপার, কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ পেপার, পাসপোর্ট সব। শুধুমাত্র
পড়নের কাপড় আর হাতের বালাদু’টিই ছিল ওর একমাত্র সম্বল। একটা সূতো পর্যন্তও
অবশিষ্ট ছিলো না সুলোচনার। অথচ তখনও ওর একবারও মনে হয়নি যে, এসব চিরঞ্জিতের
কাজ। বসে থাকে ওর অপেক্ষায়। কিন্তু কোথায় চিরঞ্জিত?
কখন যে চিরঞ্জিত এসে সব হাতিয়ে নিয়ে গিয়েছে, ঘূণাক্ষরেও টের পেলনা সুলোচনা।
এমনকি যে বাড়িতে ওরা থাকতো, সেটাও অন্যের মালিকাধিনে চুক্তিবদ্ধ করে গচ্ছিত
রেখে গিয়েছে। তারপরও বিরহ-কাতর সুলোচনার নিস্পাপ মন চিরঞ্জিতের অপেক্ষায় পথ
চেয়ে বসে ছিল! ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, চিরঞ্জিত ফিরে আসবেই! কিন্তু চাকুরীর
ইন্টারভিউ দেবার বাহানায় ঊষার প্রথম প্রহরে ঘন কূয়াশায় গা-ঢাকা দিয়ে বাড়ি
থেকে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি চিরঞ্জিত। অথচ মাত্র কয়েক
ঘন্টার ব্যবধান! অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল চিরঞ্জিত। কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে বেশ কিছুক্ষণ
সুলোচনার মুখপানে পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে ছিল। তখন মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো
প্রয়োজনেই বোধহয়! কিন্তু দৃষ্টিটা অন্যদিনের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম মনে
হতেই ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সুলোচনা। ইতিপূর্বে কিছু বলার সুযোগ
না দিয়েই চিরঞ্জিত মুখ ফিরিয়ে মায়া মরীচিকার মতো চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল
ঘন কূয়াশার মাঝে। তখন কি একবারও ভাবতে পেরেছিল সুলোচনা, চিরদিনের মতো বিদায়
নিয়ে চিরঞ্জিত ওর জীবন থেকে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল!
সুলোচনা আজ পথের ভিখিরী। অনুতাপ আর অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে জীবনের সব
চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা, বিশ্বাস-ভালোবাসা, ভালোবাসার
ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা জ্বলে পড়ে সব ছাই হয়ে গিয়েছে। মরে গিয়েছে
ওর বেঁচে থাকার সাধ। কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। কানাডার মতো দেশে
থেকেও শুধু প্রাণটা নিয়েই এতিমের মতো শহরের অখ্যাত অলিতে-গলিতে অপদস্থ,
প্রবঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়ে অস্তগামী সূর্যের মতো প্রহর গুনছে মৃত্যুর
অপেক্ষায়।
সমাপ্ত
যুথিকা বড়ুয়া: টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
Jbaruajcanada@gmail.com
|