|
লাল পা
জাহেদ মোতালেব
প্রেস ক্লাব থেকে বের হয়ে দেখলাম মায়ের কোলে অসাধারণ সুন্দর এক শিশু। বয়স
একদিন বা দুদিন হবে। লালচে মুখ, ঘুম ঘুম। ছাতিমগাছের ছায়া লম্বা হয়ে এসে
পড়েছে তার মুখে। মা-টা একটু একটু হাসছিল। তার মুখে কিছুটা রোদ। দেখে মনটা
ভালো হয়ে গেল।
মিতুর কথা মনে পড়ল। সে দেখলে খুব খুশি হত। মোবাইলে ছবি তুলে ফেললে বেশ হয়।
কিন্তু অপরিচিত মহিলার কাছে গিয়ে কি বলা যায়, আপনার সন্তানের একটা ছবি তুলতে
চাই। মহিলা হয়ত সন্দেহের চোখে তাকাবে। কিংবা ওখান থেকে সরেও যেতে পারে। শেষে
না আবার সিনক্রিয়েট হয়। শিশুটির ছবি মনে গেঁথে নিয়ে হাঁটি।
শিশুটির ছবি শিশুদের মতোই আনন্দিত হয়ে দেখত মিতু। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে
হাসত। তারপর তার মুখে গাঢ় স্বপ্নের খেলা দেখতাম। অদ্ভুত স্বপ্নময় চোখে বলত,
দেখিও, আমাদের স্বপ্ন অসাধারণ সুন্দর হবে।
জামালখানের আইল্যান্ডের গাছগুলো দেখতে দেখতে আমি হাঁটি। অনেকগুলো অশ্বত্থ,
বট, দেবদারু, চাঁপা, কৃষ্ণচূড়ায় রাস্তাটা ভরে আছে। হাঁটতে হাঁটতে আফসোস হয়।
আমি আসলে হাঁদারাম। না হয় সহজেই একটা ছবি নিতে পারতাম। প্রথমে তাকে সালাম
দিতাম। অপরিচিত দেখে সালামের জবাব না দিয়ে কিছুটা অবাক চোখে হয়ত তাকাত।
বলতাম, আপা কিছু মনে করবেন না, আপনার সন্তানের একটা ছবি তুলতে চাই।
কেন?
আমার স্ত্রীর জন্য। এর ছবি দেখলে সে খুব খুশি হবে।
মহিলা জিজ্ঞেস করবে, আপনার স্ত্রী কি সন্তানসম্ভবা?
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়ব।
তখন ছবি তুলতে দেবে।
ওই মহিলার কাছে যাব কিনা ভাবি। কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছা আর জাগে না।
জামালখানের ফুটপাত, সবজি ও ফলমূলের দোকান, মানুষজন ফেলে গেলাম সানমার ¯িপ্রং
গার্ডেনে। দ্বিতীয়ায় ঢুকলাম।
সাগর অসুস্থÑএ কথা শুনেছি রুবেলের কাছে। আজ তাকে পেলাম। হুমায়ূন আহমেদের
কিশোর উপন্যাস পড়ছিল।
কেমন আছ?
এখনো পুরো ভালো হইনি। আরো দুইদিন লাগবে। বলেই একটু কাশে। গলার স্বরটা জ্বর
জ্বর, চেহারা কিছুটা অনুজ্জ্বল।
দোকানের বইগুলোতে চোখ বুলাই। পত্রিকা পড়ে আছে টেবিলে। টেনে নিই। দেখতে দেখতে
একটা ফিচারে চোখ আটকে যায়। ওখানে লিখেছে : নবজাতকের প্রথম ‘টিকা’ শালদুধ।
নবজাতকের প্রথম ‘টিকা’ অবশ্যই শিশুর জন্মের প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়াতে
হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, এই টিকার নাম ‘কলস্ট্রাম’। সাধারণ মানুষের
কাছে যা ‘শালদুধ’ নামে পরিচিত। ...শালদুধ বিশেষ গুণসম্পন্ন বলে
তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর এবং একই সঙ্গে অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। আর সে
জন্যই শালদুধ হচ্ছে শিশুর প্রথম টিকা। ...একটি শিশুর খাবার হিসেবে, রোগ
প্রতিরোধক হিসেবে যা যা প্রয়োজন এর সবই শালদুধে আছে।
পড়তে পড়তে মনে পড়ল সোমবারের কথা। ওইদিন দুপুরে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছিল।
গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। মিতু তেৎসুকো কুরোয়ানাগির ‘তোত্তো-চান’ পড়ছিল। জাপানি
পিচ্চি মেয়েটার গল্প। আমি পাশে বসে আকাশ দেখছি। এ সময় ওরা এল। যেন কোনো
অভিযাত্রী দল। মেঘের ওপার থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছে। তাদের একজনের নাম
জয়দুনমালা। বয়স কত? এ চার-পাঁচ। শিমের বিচি দাঁত দিয়ে ভাঙলে যেরকম আওয়াজ হয়
ও কথা বলে সেরকম স্বরে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিও তেমন। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে মায়ের
কণ্ঠ নকল করে বলে, আল্লার ওয়াস্তে ভিক্ষা দেন মা।
তোমাদের বাড়ি কোথায়?
প্রশ্ন শুনে মালা মিষ্টি হাসে। কিছুটা টেনে বলে, বাঘমারা বিশ্বরোড। বলে
মা’র দিকে তাকায়।
বাঘমারা কোথায়?
ধূসর শাড়িটার মতো তার মায়ের চেহারাও ফেকাসে। অনুচ্চ কণ্ঠে মা বলে, লাকসাম।
লাকসাম শব্দটা যেন গরুর গাড়ির চাকা। চাকার শব্দ শুনে শুনে সে চট্টগ্রামের
ফটিকছড়িতে এসেছে ভিক্ষা করতে। অথচ তার শরীর শক্ত সমর্থ।
মালার চেহারার আরেকজন অদূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। হেই, তোমার নাম কি?
প্রশ্ন শুনে নাচের মতো নড়াচড়া করে সে। মুখ ঘুরিয়ে বলে, সুন্দরী।
নাম বলে সে খুব মজা পায়। দুই বোনই একই কায়দায় স্কার্টটা কোমর থেকে নিচের
দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। গা খালি। বৃষ্টি থেমেছে একটু আগে। এখনো গাছের, টিনের
গা থেকে পানি ঝরছে। মিতু প্লেটে করে চাল এনে দেয়। তারা মেঘের মতো হেঁটে
হেঁটে চলে যায়। বৃষ্টি হয়ে আমার ভেতর ঝরে পড়ে। খুব লজ্জা লাগে। কেমন
অবস্থায় পড়লে মানুষ সন্তানকে ভিক্ষার সঙ্গী করে ভেবে পাই না।
সাগর বলল, চলেন, বাইরে দাঁড়াই।
অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি। এর মধ্যে কয়েকবার ঢু মেরেছিলাম।
কয়েকদিন খুব অনিয়ম হয়েছে। তার ফল ভোগ করতে হলো। সেদিন একজনে একটা রেড লেবেল
গিফট করল, খাঁটি স্কটিশ। ছয়-সাত হাজার টাকা হবে। বাড়িতে কেউ ছিল না। বরফ
দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাইছি।
ও, সে জন্য তুমি ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেছ। মৃদু হেসে বললাম।
শ্রাবণের দুপুরে উজ্জ্বল রোদ। বটগাছে তার ছায়া মনোরম। বটে ফল এসেছে। মনে
হলো ফলগুলো শীতের মতো রোদ পোহাচ্ছে।
গ্রন্থসুর থেকে এগিয়ে এল অনিক। আমাদের পাশ দিয়ে পরিচিত চেহারার শ্যামলা
মেয়েটা দ্বিতীয়ায় ঢোকে। দরজা খুলে আয়েশি ভঙ্গিতে ঢোকাটা খুব সুন্দর। সাথে
সাথে সাগরও ঢোকে। একটু পর মেয়েটা কয়েকটা পেপার ভাঁজ করে নিয়ে চলে যায়।
সাগর এসে বলে, ওইদিন ও আমাকে দেখতে গিয়েছিল। ভাই, কমলকুমারের ‘লাল জুতা’
গল্প আছে না? সেরকম জুতা নিয়ে গিয়েছিল।
বাচ্চাদের জুতা? অনিক জানতে চায়।
হ্যাঁ, এত্তটুকু লাল জুতা।
কেন? তোমার কি বাচ্চা হবে?
এ কথায় আমরা প্রাণ খুলে হাসি।
সাগর বলে, সেরা কথা হইছে। মনটা ভালো হয়ে গেল।
আমার মেয়েরও ও রকম একজোড়া জুতা আছে। অনিক বলল।
আমি বলি, জুতা কেন দিল?
এমনি দিছে আর কি।
আমি একটা গল্প লিখব। গল্পের নাম হবে ‘লাল জুতা ২’।
অনিক বলে, না, গল্পের নাম হবে ‘আবারো লাল জুতা’ অথবা ‘এখনো লাল জুতা’।
হাত নেড়ে নেড়ে সাগর বলে, রোববার এক কাণ্ড হইছে। রুবি গেটে আমার মা-বাবা
অ্যাকসিডেন্ট করছে। এ কথা শুনে আশঙ্কায় আমরা কেঁপে উঠি।
না, কারো কিছু হয়নি। সে আশ্বস্ত করে। শুধু বাবার চোখে ব্যথা পাইছে। নিয়ে
গেল পাহাড়তলী আই হসপিটাল। এদিকে ঘরে কেউ নাই। আমি পুটুস পুটুস মারছিলাম।
কয়েক পেগ খেয়ে ফেললাম বরফ মিশিয়ে। তখনই ফোন এল। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। রিকশায়
উঠতে পারছিলাম না। কোনোমতে গেলাম। আমাকে দেখে ওরা বুঝতে পারল। পরে বোনের
বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হলাম। কাল দেখি যে জায়গায় বোতলটা রাখছি, প্যাকেট আছে বোতল
নাই। খুব মজা পাইছি।
বিদেশি মদের বোতলগুলো যা সুন্দর! অনিক বলল। দেওয়ানহাটে আমাদের ছোটবেলায়
আমরা খালি বোতল কিনতাম।
আমি বলি, বাংলাদেশে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মদ খাওয়া হয়, না?
অনিক বলে, গুলশান বনানীতে মদের খালি বোতল নিয়ে রীতিমত ঝগড়া হয়। ওখানে ঝুট
কাপড়ের মতো এটার ব্যবসা আছে।
সাগর বলে, খাওয়া দাওয়া কীভাবে করেন?
রোজা রেখেছি তো। বলি আমি। খুব আরামে আছি। সারাদিন খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা
নাই। সন্ধ্যা হলে ইফতার খাও। তাছাড়া পাকস্থলিটা একটু বিশ্রাম পাচ্ছে।
খাবার খেতে যা কষ্ট ভাই।
আর বলিও না। দোকানগুলোতে সিগারেটের গন্ধে ঢোকা যায় না। ঢুকেই লোকজন
রাক্ষসের মতো খানা খায় আর ফাঁৎ ফাঁৎ সিগারেট টানে।
হুমায়ূনের মৃত্যুর পর ফেসবুকে কয়েকজনের স্ট্যাটাস দেখে সাগর খুবই বিরক্ত।
বলে, আমি মুশফিকের স্ট্যাটাসে লিখছি, এত কথা না বলে লেখেন না তার মতো একটা
উপন্যাস।
অনিককে বলল, আচ্ছা, বামপন্থীরা হুমায়ূনের শোক সভা করবে না?
অনিক কিছু বলে না।
হুমায়ূন নিয়ে আগে সাগরের নাক সিটকানো ভাব ছিল। ইদানীং অনেক সহনশীল। কয়েকদিন
আগে তাঁর একটা বই থেকে কিছু অংশ আমাকে পড়ে শুনিয়েছিল।
গতকাল ছিল বৃষ্টি। আজ ঝকঝকে রোদ। সানমারের বারান্দায় আমাদের চেহারায় রোদের
আভা। গ্রন্থসুরের ক্যাশে বসে থাকা সুহাসদার বিষণœ চোখের দিকে তাকাই। সাগর
এখন ঠিক দুপুরের মতো। এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অনিকের দাড়ি
অনেক লম্বা হয়েছে। বর্ষার দূর্বা ঘাস যেন।
সানমার থেকে বের হয়ে ফুটপাতে সিটি কর্পোরেশনের লোকটার সাথে দেখা। সাংঘাতিক
সাহেব, কোথায় যাচ্ছেন? লোকটা বলল।
মৃদু হেসে বললাম, দেখি, কারো মাথায় কাঁঠাল ভাঙা যায় কিনা। মনে মনে বলি,
ব্যাটা ঘুষখোর, বদের হাঁড়ি।
পৃথিবীর সব লোক তার কাছে খারাপ। সে ভালো চোখে কোনোদিকে তাকাতে পারে না।
চোখগুলো একেবারে অমানুষের মতো। একটা ফিচারের কাজে তার কাছে বেশ কয়েকবার
যেতে হয়েছিল। একদিন বলল, আপনারা গু থেকেও টাকা তুলে নেন।
এ কথা শুনে আমার এত রাগ হলো, অনেক কথা বলতে চাইলাম। বলতে চেয়েছিলাম, আপনার
ক্ষেত্রেই কথাটা একশ ভাগ সত্য। ভুলে ‘আমি’র জায়গায় ‘আপনারা’ বলেছেন।
চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত ভাবলাম। মাথামোটাকে কিছু বলে লাভ নাই। যা
ত্যাদড়! হাতের পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বললাম, দেখেন, এগুলো কিন্তু সমান না।
আমি যাব আন্দরকিল্লা। হেঁটে যাব না বাসে দ্রুত চলে যাব ভাবতে ভাবতে বাসটা
আমাকে পেছনে ফেলে। বাসের পেছনে একটা স্টিকার। লাল রঙে লেখা আছে : আজকে সবার
একটি ইস্যু/সুস্থ মা ও সুস্থ শিশু। পড়ে আমি হাসি। মিতুর কথা, স্বপ্নের কথা
মনে পড়ে যায়।
আন্দরকিল্লার দিকে হাঁটি। জয়ের অফিসে যাব। শিশুর কোমল পায়ের ছোঁয়া পেয়ে
যেমন মজা লাগে রোদগুলো তেমন। হাঁটতে হাঁটতে এক জোড়া পায়ের কথা মনে পড়ে।
অবিরত নাচানাচি করে এমন পা, একেবারে লাল লাল। জন্মেই যেন জুতা পরে আসে। এ
পায়ে আর কোনো জুতার দরকার হয় না। মায়ের সব কষ্ট, স্বপ্ন যেন ওই পায়ে মাখানো
থাকে। এ রকম পা দেখার অপেক্ষায় আছি। আর কয়দিন পর সে আসবে। রোদ যেমন আমার
গালে লেগে আছে সেভাবে তার পা দুটা দুই গালে লাগাব। বলব, বাবা, তোর জন্য
অনেকগুলো গাছ লাগাব। একটি গাছের নাম রাখব... থাক, তুই এলে তখন তোকে নামটা
বলব।
রোদটা কোথাও লুকিয়ে অকস্মাৎ শুরু হয় বৃষ্টি। শ্রাবণের সে কি বৃষ্টি! বৃষ্টি
বৃষ্টি বৃষ্টি, প্রাণের উল্লাস। হাঁটতে হাঁটতে আমি বৃষ্টির ফোঁটার মতো হয়ে
যাই। বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে গাছপালা ঘেরা টিনের চালের বাড়িটাতে যাই। ওখানে
একটা শিশু ওঁয়াওঁয়া করে কাঁদছে।
ব্যাঙেরা ডেকে ডেকে বলছে, ওটা তোমাদের স্বপ্ন।
আমার আওয়াজ পেয়ে মিতু দরজা খুলে দেয়। তার মুখে অদ্ভুত লাবণ্য। গর্বিত মুখে
সে হাসে। গায়ে মা মা গন্ধ। ঘরে ঢুকে দেখি, স্বপ্নœ পা নাড়ছে। পাগুলো লাল,
গভীর ভালোবাসার মতো সুন্দর। দুই পা নিয়ে আমার গালে লাগাই। ওমা! লাল পায়ের
ছোঁয়ায় তুলার মতো হয়ে যাই আমি।
তুলা উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে বৃষ্টিতে ভিজে নিচে পড়ে যাই। মাটির স্পর্শে
নিজের কাছে ফিরে আসি। আমি হাঁটি। লাল পায়ের শিশুটির কাছে যাব। বৃষ্টির গান
শুনতে শুনতে বুকে জড়িয়ে নেব ওই দুটা পা।
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
|